মাত্র ৪ আর ৫ বছর বয়সী নাঈমা আর আহমুদুল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে এসে সারাক্ষণ বড় বোন আইরিনকে জাপ্টে ধরে বসে ছিল। বড় বোন আইরিনের বয়সই মাত্র ১০ বছর। দুই বছর আগে পিতার মৃত্যুর পর যে মা আগলে রেখেছিলেন তিনিও এখন জেলে। তাই বড় বোন আইরিনই জান্নাতুল নাঈমা আর আহমাদুল্লাহর একমাত্র ভরসা। সেই তাদের মা-বাবা।
ঘটনাটি ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌর সদরের পোল্ট্রি মুরগি ব্যবসায়ী মৃত আমিন শেখ ও পপি খাতুন দম্পতির শিশু তিন সন্তান আইরিন, আহমাদুল্লাহ আর জানাতুন নাঈমার।
অপ্রাপ্তবয়সস্ক এতিম এই তিন শিশু তাদের বাবার ঋণের কারণে ব্র্যাক ব্যাংকের দায়ের করা মামলার আসামি। পিতার মৃত্যুর শোক মা বুঝতে না দিলেও বর্তমানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন তিনি।
পিতার মৃত্যুর পর বেহাত হয়ে গেছে ব্যবসা। পাওনাদাররা চাপ দিলেও দেনাদার কেউ মুখ খোলেনি। জমি জমা কিছুই নেই, নেই ভিটে মাটি। সহায় সম্বল হারিয়ে তিন এতিম শিশু আশ্রয় পেয়েছে নানার কাছে।
রোববার (২৬ জানুয়ারি) এ ঘটনায় অবুঝ তিন শিশুকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন নানা সিরাজ শেখ।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমার মেয়ের জামাই বোয়ালমারী বাজারের পোল্ট্রি মুরগি ব্যবসায়ী আমিন শেখ ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর পর জানতে পারি, সে ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি বোয়ালমারী শাখা থেকে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এরমধ্যে জীবিত থাকা অবস্থায় কিস্তিতে সুদে আসলে ৬ লাখ ২১ হাজার ৩৭৮ টাকা পরিশোধ করে। তার মৃত্যুর পর ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর ফরিদপুর জেলা জজ অর্থঋণ আদালতে আমার মেয়ে পপি খাতুন, তার তিন এতিম নাবালক শিশু সন্তানসহ, আমিন শেখের মা সালেহা বেগম ও মো. চুন্নু মিয়ার নাম করে ছয়জনের নামে মামলা করে। যাতে ২৫ লাখ ৯৩ হাজার ২৮৩ আসল, ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩২৯ টাকা সুদ ও ৬০ হাজার ৫৭০ টাকা আইনি খরচ বাবদ মোট ২৯ লাখ ৯৩ হাজার ১৩৮ টাকা পরিশোধের ডিক্রি জারি করেন আদালত। অথচ মামলার বিষয়ে কিছুই জানত না আসামিগণ।
‘মামলার বিবরণে ফরিদপুর জজ আদালতের বাদীপক্ষের আইনজীবী তার স্বাক্ষরিত আর্জিতে বিবাদীগণের নামে ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর লিগ্যাল নোটিশ জারি করেছেন বলে দাবি করেছেন। অথচ ঋণ গৃহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন তারও ১ বছর পর ২০২২ সালে। গত ২ ডিসেম্বর মোসা. পপি খাতুন গ্রেপ্তার হলে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন মৃত আমিন শেখের ঋণের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়- ব্র্যাক ব্যাংক পিএলসি বোয়ালমারী শাখা আমিন শেখের দুই নাবালক মেয়ে ও নাবালক ছেলের বয়স গোপন করে তাদেরও মামলার আসামি করেছে। মায়ের গ্রেপ্তারের পর থেকেই একই মামলার আসামি ৩টি এতিম নাবালক শিশু সারাক্ষণ শঙ্কা ও আতংকের মধ্যে থাকে।
সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিশু আইরিন বলেন, ‘ভাইবোন দুটো পুলিশের ভয়ে কাঁন্দে, না জানি কখন আমাগেরও ধরবার আসে। ঘুমের ঘরেও ওরা পুলিশ পুলিশ কইয়ে কাঁন্দে উঠে। আমার আব্বার লোন মাফ করে আমার মারে ছাড়ায় আইনে দেন।’
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংক বোয়ালমারী শাখার ব্যবস্থাপক রাসেল আহমেদ বলেন, ঋণ গ্রহীতা মৃত আমিন শেখ আমাদের শাখা থেকে ত্রিশ লাখ টাকা ঋণ নেয়। আমাদের ব্যাংকের শর্ত ও নিয়মের মধ্যে থেকেই চলমান ব্যবসার অনুকূলে ঋণ দেওয়া হয়েছে। শর্তাবলি মেনেই ঋণের টাকা অনাদায়ে জামিনদার ও ওয়ারিশগণের নামে মামলা হয়েছে। আমাদের ব্যাংক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনের ব্যত্যয় হোক এমন কিছুই করা হয়নি। এতিম নাবালক শিশু সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে আমাদের আইনজীবী ভালো বলতে পারবেন।
বিবাদী পক্ষের আইনজীবী মেহেদী হাসান বলেন, মৃত আমিন শেখের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ৩টি অবুঝ শিশুকে এ মামলায় ওয়ারিশ সূত্রে আসামি করা হয়েছে। তারা ওয়ারিশ হলেও বয়ঃপ্রাপ্তির আগে পিতার সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের আসামি করা তামামি আইন সমর্থন করে না। এটা স্পষ্ট আইনের ধারায় উল্লেখ রয়েছে। শিশুদের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছে নিঃসন্দেহে তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আদালতকে ভুল তথ্য দিয়েছে। এটা আদালত অবমাননার শামিল।
মন্তব্য করুন