কুমিল্লার তিতাস উপজেলার আসমানিয়া বাজারে গোমতী নদীর ওপর নির্মাণাধীন পাকা সেতুর পাশে বিকল্প সেতুটি বন্যায় ভেঙে যায়। ভেঙে পড়ার ৫ মাস অতিবাহিত হলেও পুনর্নির্মাণ হয়নি বিকল্প সেতু। এতে ভোগান্তি নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পারাপার হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীসহ দুই পাড়ের ৪০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ।
সরেজমিনে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির রায়পুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তিতাসের বাতাকান্দি বাজার পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার সড়কের আসমানিয়া বাজার এলাকায় গোমতী নদীর ওপর ১০ কোটি ৭৭ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৯ টাকা ব্যয়ে ৭৫ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে।
নদীর দুই পাড়ের মানুষের চলাচলের জন্য নির্মাণাধীন সেতুর পাশেই ৮০ মিটারের একটি বিকল্প সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। যা গত বছরের ২৯ মে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় ভেঙে যায়। পরে বাল্কহেডের মালিকদের সহযোগিতায় পুনরায় অস্থায়ী সেতুটি নির্মাণ করা হয়। বন্যার পানির প্রবল স্রোতে গত বছরের ২১ আগস্ট কাঠের ওই সেতুটি দ্বিতীয়বারের মতো ভেঙে যায়। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীসহ নদীর দুই পাড়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। তারা আপাতত ইঞ্জিনচালিত নৌকায় (ট্রলারে) নদী পারাপার হচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, গোমতী নদীর দক্ষিণ-পূর্বপাশে উপজেলার অন্যতম বৃহত্তর আসমানিয়া বাজার অবস্থিত। প্রতিদিন উত্তর-পশ্চিম পাড়ের গ্রামের লোকজন ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে আসমানিয়া বাজারে যাতায়াত করে। দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ের গ্রামের লোকজন আসমানিয়া বাজার হয়ে উপজেলা সদরে আসা-যাওয়া করে। এছাড়াও আশপাশের কয়েক উপজেলার মানুষের যাতায়াত রয়েছে আসমানিয়া বাজারে।
নদীর দুই পাড়ের গ্রামগুলোতে বেগম রোকেয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাইন আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, নারান্দিয়া কলিমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, ইকরা মডেল স্কুল, গ্রামীণ প্রি-ক্যাডেট স্কুল, মেহেনাজ হোসেন মিম আদর্শ সরকারি কলেজ, আমেনা মমতাজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, দারুন নাজাত মাদ্রাসা, তালীমুদ দ্বীন ক্যাডেট মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা, ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় রয়েছে।
গোমতী নদীর উত্তর-পশ্চিম পাড়ে রয়েছে নারায়ণপুর, হরিপুর, রতনপুর, কদমতলী, আলীনগর, পোড়াকান্দি, ভিটিকান্দি, দাসকান্দি, হাড়াইকান্দি, চরেরগাঁও, বলরামপুর, মাছিমপুর, কলাকান্দি, নারান্দিয়া পশ্চিম পাড়, নয়াকান্দি, দুঃখিয়ারকান্দি, ভাটিবন, তারিয়াকান্দি, সোনাকান্দা, বালুয়াকান্দি, কাচারি ও তুলাকান্দি গ্রাম এবং নদীর দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ে রয়েছে দড়িকান্দি, দুলারামপুর, খলিলাবাদ, জগতপুর, হাইধনকান্দি, মানিককান্দি, ছালিয়াকান্দি, নয়াচর, কাশিপুর, রঘুনাথপুর, কালিপুর, সেম্বুপুর, সাতানি, নয়ানি, দক্ষিণ নারান্দিয়া, কুশিয়ারা, আউটবাগ, ভেলানগর, আসমানিয়া ও খোশকান্দি গ্রাম।
বেগম রোকেয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাদিকা ইসলাম জুই জানায়, ‘ট্রলারে করে আমাদের যাতায়াতে অনেক সমস্যা হয়। ক্লাস ও পরীক্ষায় অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। আমরা যখন সকালে স্কুলে যাই, বাসায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের মায়েরা দুশ্চিন্তায় থাকে। আমাদের বেগম রোকেয়া কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছোট ছোট শিশুরা কিন্তু সাঁতার জানে না, এর কারণে প্রাণহানিও হতে পারে। এ দায় কিন্তু কেউ নিবে না। আমাদের মায়েদের যেন দুশ্চিন্তা না করতে হয় এবং আমরা যেন নিরাপদে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পারি সেই ব্যবস্থা করে দেওয়ার আবেদন করছি।’
আসমানিয়া বাজারের ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম হানিফ কালবেলাকে বলেন, `আসমানিয়া বাজার তিতাস উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। এই বাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে গোমতী নদীর ওপর দিয়ে। ব্রিজটি ভাঙার পর থেকে এলাকাবাসীর দুর্ভোগের শেষ নেই। সেই সঙ্গে বাজারের ব্যবসায়ীরা একেবারে পথে বসেছে। ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা একদম বন্ধ হয়ে গেছে।`
বাজারের ব্যবসায়ী বিল্লাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, `বাজারে আগে ৪০-৫০টি গ্রামের মানুষ নিয়মিত বাজার করতে আসত। ব্রিজ ভাঙার পর থেকে এখন তাদের দেখা যায় না। ভারী মালামাল নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই তারা এখন আসমানিয়া বাজারে আসে না। যেখানে আমার দোকানে বিক্রি হতো ৫০ হাজার টাকা, সেখানে এখন ১০ হাজার টাকাও বিক্রি সম্ভব হয় না। যেখানে আমি দৈনিক চাল বিক্রি করতাম ১০-১৫ বস্তা, সেখানে এখন সপ্তাহে ১০-১৫ বস্তা চাল বিক্রি হয়। আমরা ব্যবসায়ীরা তো ভোগান্তির মধ্যে আছিই। নদীর পশ্চিম পাড়ের লোকজনও ভোগান্তিতে আছে, তারা চলাচলের সুব্যবস্থা না থাকায় এখন বাজারে আসতেছে না।
নারান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ছবির হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘ব্রিজটি না থাকায় সাধারণ মানুষজন নৌকা দিয়ে যাতায়াত করছে, নৌকাও রাতে বন্ধ হয়ে যায়। নৌকা বন্ধ হয়ে গেলে পাড়ে গিয়ে ডাকাডাকি করে লোকজনকে ফেরতও যেতে হয়।’
আসমানিয়া বেগম রোকেয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মো. গোলাম কিবরিয়া কালবেলাকে বলেন, বাজারের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মিনিমাম পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। নৌকা দিয়ে চলাচলের সময় ৫-৭টা বাচ্চা নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। জুনিয়র শাখার অনেক ছোট ছোট বাচ্চা ভয়ে স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। অনেক অভিভাবকের মুখ থেকে শুনি, ব্রিজ না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের সন্তানকে স্কুলে দিতে ভরসা পাচ্ছেন না।`
তিতাস উপজেলা প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আকস্মিক বন্যায় গোমতী নদীর বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল এবং পানির প্রবল স্রোত ছিল, যার কারণে অস্থায়ী সেতুটি ভেঙে যায়। এখন নৌকা দিয়ে পথচারীরা পারাপার হচ্ছেন, এতে কিছুটা জনদুর্ভোগ হচ্ছে। আমরা ব্রিজের কাজে খুবই গুরুত্ব দিয়েছি। চেষ্টা করব এপ্রিলের মধ্যে ব্রিজের কাজটি সম্পন্ন করে দেওয়ার জন্য। তিতাসের তিন থেকে চারটি বাজারের মধ্যে আসমানিয়া বাজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাজার। সেই গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে ব্রিজের কাজটি খুব দ্রুত শেষ করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।’
মন্তব্য করুন