সুনামগঞ্জ দিরাই উপজেলার কালনী নদীতে বংশানুক্রমে প্রায় ৫০ বছর ধরে নৌকায় বসবাস করে আসছে বেদে সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ। স্থানীয়ভাবে তাদের বলা হয় বাইদ্যা। পূর্বপুরুষের সেই জীবনধারা থেকে তারা এবার বের হতে চান।নৌকা ছেড়ে উঠতে চান ডাঙায়।
সম্প্রতি কথা হয় উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের চাঁন্দপুর গ্রামের কালনী নদীতে থাকা একদল বেদে পরিবারের সঙ্গে। তারা জানান, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রায় ৫০ বছর ধরে এ সম্প্রদায়ের লোকজন নৌকায় বাস। সম্প্রদায়ের বর্তমান প্রজন্ম আর নৌকায় বসবাস করতে চান না, তাদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে চাঁন্দপুর গ্রামে বসবাসের জায়গা কিনেছেন। কেউ কেউ ঘর নির্মাণ করে ইতোমধ্যে বসবাস করছেনও।
সম্প্রদায়ের একজন আসমিনা বেগম জানান, তারা অনেক বছর ধরে নৌকায় বসবাস করে আসছেন। নৌকা অনেক ছোট, নৌকায় বসবাস করা অনেক কষ্টসাধ্য, তারা এখন ডাঙায় উঠতে চাই। কিন্তু তাদের কেউ সাহায্য সহযোগিতা করে না।
জামাল হোসেন নামে আরেকজন জানান, তার ২ ছেলে ১ মেয়ে আছে। এ ছাড়া এক নাতিন সামনের বিদ্যালয়ে পড়ে। এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাদের সন্তানরা আদি পেশায় আকৃষ্ট হয় না, তাই অনেকে এ কাজ ছেড়ে অন্য কাজ করছেন। এ জন্য তারাও নৌকা ছেড়ে ডাঙায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চায়।
মকবুল হোসেন জানান, তারা ৪ ভাই, ২ ভাই এখানে নৌকায় থাকেন। আর ১ ভাই গার্মেন্টস ও ১ ভাই ওয়ার্কশপে কাজ করে। তিনি বলেন, ‘নৌকায় থাকতে অনেক কষ্ট হয়। টাকা পয়সা নাই, থাকলে কি আর নৌকায় পড়ে থাকি।’
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, প্রায় ৫০ বছর ধরে চাঁন্দপুর গ্রামসংলগ্ন কালনী নদীতে নৌকায় জীবনযাপন করে আসছেন। নৌকায় রাঁধেন, নৌকায় খান, নৌকায় ঘুমান। বর্তমানে ১৩টি নৌকায় ১১টি পরিবার বসবাস করে আসছে। তবে তারা অন্যান্য বেদে সম্প্রদায়ের মতো সাপ খেলা দেখান না, তাবিজ-কবচ বেচে সংসার চালান না। উপার্জনের ক্ষেত্রে বেদেরা নারী নির্ভরশীল। বেদে পরিবারগুলোর নারীরা মাথায় টুকরি করে শহরে ও গ্রামে গ্রামে গিয়ে নারীদের ও শিশুদের কসমেটিক ও বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিস বিক্রয় করে বেড়ান। অনেক পুরুষকে গ্রামে গ্রামে গিয়ে শঙ্খ শাঁখা বিক্রি করতে দেখা যায়। বর্তমানে অনেকেই অন্যান্য পেশায় যুক্ত হয়েও জীবিকা নির্বাহ করা শুরু করেছেন। এসব নারী ও পুরুষরা প্রতিদিন সকাল বেলায় শহর ও গ্রামে গ্রামে ফেরি করে হরেক পণ্য বিক্রি করেন, আর দিন শেষে পুনরায় নৌকায় ফিরে আসেন। তাদের জীবনযাপনের কিছু ব্যাপার যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি কিছু ব্যাপার কষ্টেরও।
টুকদিরাই গ্রামের বাসিন্দা রনবির দাস বলেন, এখানে উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের বাইদ্যা রয়েছে। উচ্চবর্ণের বাইদ্যাদের সরদার ছিলেন নয়ন বাইদ্যা। তার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল। আর এই নয়ন বাইদ্যার দলের লোকজনদের বেশিরভাগ এখন নৌকা ছেড়ে টুকদিরাই গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। রয়েছে বেদে হাটি (স্থানীয়দের কাছে বাইদ্যা হাটি নামে পরিচিত)। তাদের একটা অংশ ডাঙায় স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও আরেকটা অংশ গ্রামের পাশে নদীতে নৌকায় ভাসমান অবস্থায় বসবাস করে। টুকদিরাই নিজের গ্রাম হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তাদের এভাবে নৌকায় ভাসমান অবস্থায় জীবনযাপন করতে দেখে আসছি।
করিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লিটন চন্দ্র দাস বলেন, এই বাইদ্যা পরিবারগুলো অনেক বছর ধরে চাঁন্দপুর গ্রামের কালনী নদীর কূল ঘেঁষে বসবাস করে আসছে। এদের মধ্যে অনেকে এনআইডি কার্ডও করে ফেলেছে। তাদেরকে ভিজিএফ’র চালসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন