সুনামগঞ্জে চাঁদা না পেয়ে ঠিকাদারকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে আরিফ রব্বানী হিমেল নামে এক যুবদল নেতার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ঠিকাদার রেজাউল আলম বাদী হয়ে হিমেলসহ ছয়জনকে আসামি করে বিশ্বম্ভরপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযুক্ত আরিফ রব্বানী হিমেল বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক। তিনি সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলামের ছেলে এবং বিশ্বম্ভপুর ছাত্রদলের সদস্যসচিব কোহিনূরের ভাই।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ডিসেম্বরে আরিফ রাব্বানী হিমেলের নেতৃত্বে কয়েকজনের একটি দল ফতেপুর ইউনিয়নের রঙ্গিয়ারচর এলাকায় সরকারি আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ঠিকাদার রেজাউল আলমের কাছে চাঁদা দাবি করেন। বিষয়টি জানাজানি হলে এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা বিএনপির একটি অংশ। ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
ঠিকাদার রেজাউল আলম বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রের কাজ চলা অবস্থায় হিমেল আমার কাছে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। গত ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় হিমেল তার বাহিনী নিয়ে চাঁদা আদায় করতে আমার বাসায় যায়। সেখানে আমাকে না পেয়ে আমার স্ত্রীকে গালাগাল করে। পরে স্থানীয় শাহজাহানের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আমাকে দেখতে পেয়ে সেখানে তারা আমার ওপর চড়াও হয়। লাথি দিয়ে আমাকে চেয়ার থেকে ফেলে দেয়। হিমেল ও তার লোকজন মিলে আমাকে কিল, ঘুসি ও লাঠিসোঁটা দিয়ে মেরে জখম ও আহত করে। প্রাণনাশের হুমকিও দেয়। চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিয়েছি।
অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি মোখলেছুর রহমান কালবেলাকে বলেন, বিষয়টি দলীয়ভাবে মীমাংসা না হলে মামলা রেকর্ড করা হবে।
এদিকে যুবদল নেতা হিমেলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলেছেন ব্যবসায়ীসহ স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতাকর্মী।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও ব্যবসায়ী আব্বাস আলী বলেন, ‘উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে যুবদল নেতা হিমেল দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি, চোরাচালানসহ এলাকায় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে মানুষকে হয়রানি করছে। বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। প্রশাসন, পরিবহন খাত, বালুমহাল-জলমহালেও রয়েছে হিমেলের আধিপত্য। এসব জায়গা থেকে চাঁদা নেন তারা। পারিবারিকভাবে তারা গড়ে তুলেছেন বিশাল সিন্ডিকেট। সীমান্তেও রয়েছে চোরাচালান বাণিজ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘হিমেল দলবল নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ঠিকাদার রেজাউল আলমের কাছে দশ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। বিষয়টি জানার পর আমরা তাকে (রেজাউলকে) চাঁদা দিতে নিষেধ করি এবং বলি- কেউ চাঁদা দাবি করতে গেলে তাদেরকে বেঁধে রেখে আমাদের খবর দিতে। বিএনপি কাউকে চাঁদাবাজি করতে বলেনি। পরে চাঁদা না পেয়ে তারা (হিমেল গ্রুপ) আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দুজনকে মারধর করে। আমার দোকানের সব মালামাল ভেঙে দিয়ে চলে যায়। এতে আমার প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তখন আমি দোকানে ছিলাম না। পরে আমার বাসায় গিয়ে আমার ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। লোহার রড দিয়ে আমার ঘর ফুটো করে দেয়। এ ঘটনায় বিএনপির নেতারা সমাধান করে দেওয়ার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি।’
এদিকে একই দিনে (২২ ডিসেম্বর) বিশ্বম্ভরপুর থানা ভবনের সামনে উপজেলা বিএনপির কর্মী ও বিশ্বম্ভরপুর নতুন পাড়া বাজার কমিটির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান ও তার ভাইয়ের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে হিমেল ও তার গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে মো. জিয়াউর রহমান কালবেলাকে বলেন, বিশ্বম্বরপুর এলাকাবাসী এদের ওপর অতিষ্ঠ। বর্তমানে বিশ্বম্বরপুর এলাকায় বাপ-ছেলের আধিপত্য চলছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকেই তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হিমেল আমার ও আমার ভাইয়ের ওপর হামলা করে। থাই গ্লাস ব্যবসায়ী মিসবাউর রহমানের কাছে বিশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার দোকানে হামলা করে ভাঙচুর চালায় ও আহত করে। এ বিষয়ে থানা অভিযোগ দিয়েছি।
জিয়াউর রহমান আরও বলেন, হিমেল বিশ্বম্বরপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আব্বাস আলীর দোকানও ভাঙচুর করেছে। অনেক জনের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে টাকা নিয়েছে। এছাড়াও সে ফতিহপুর আশ্রয়কেন্দ্র, বালু, পাথর, বিড়ি, মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয়।
অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘হিমেল গড়ে এক থেকে দেড়লাখ টাকা চাঁদা তোলেন বিভিন্ন খাত থেকে। মাসে ৫০ লাখ টাকার টার্গেট করে প্রতিদিন বিভিন্ন অফিসে দলবল নিয়ে হানা দেন। এ জন্য তিনি একেকজনকে দিয়েছেন একেক দায়িত্ব।’
তিনি জানান, হিমেলের আপন ফুফাতো ভাই আলমগীর নিয়ন্ত্রণ করেন সীমান্তের চোরাচালান। ছাত্রদলের সদস্যসচিব কোহিনূর অবৈধ বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের সিন্ডিকেটে আছেন আরো বেশ কয়েকজন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা জানান, এই বাপ-ছেলেদের (হিমেল, কোহিনূর) অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মান-সম্মানের ভয়ে অনেকে মুখ খুলছেন না। তারা বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা বিএনপির আদর্শকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
তবে চোরাচালানের অভিযোগের বিষয়ে হিমেলের ফুফাতো ভাই আলমগীর কালবেলাকে বলেন, আমি কখনোই এই কাজের সঙ্গে জড়িত নই। আমি শুধু রাজনীতি করি, এতটুকুই জানি। বিশ্বম্বরপুরে অতীতেও চাঁদাবাজি ছিল না, এখনও নাই।
বিশ্বম্ভপুর ছাত্রদলের সদস্যসচিব কোহিনূর কালবেলাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছে, তারা আওয়ামী লীগের দোসর। মানুষকে জিজ্ঞেস করেন হিমেল কেমন, কোহিনূর কেমন। আমি সবসময় হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে চলার চেষ্টা করি। এই ধরনের কোনো কিছুতেই আমরা জড়িত না।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফ রব্বানী হিমেল কালবেলাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার সবই বানোয়াট। দলের মধ্যে কিছু লোক আছে তাদের সাঙ্গে আমার কিছুটা গন্ডগোল আছে। এটা নেতারা শেষ করবেন।
চাঁদার দাবির ব্যাপারে তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে রাজনীতি করি, এখন পাশাপাশি ঠিকাদারিও করি। আমার বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ নেই।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আমিনুর রশীদ কালবেলাকে বলেন, আমি সদ্য দায়িত্ব পেয়েছি। এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, যদি এ ধরনের কোনো অভিযোগ এবং সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে দল কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
মন্তব্য করুন