মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সমাবেশে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনে সমাবেশে উপস্থিত জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ উপস্থিত সবাই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন।
পরীক্ষার খাতা শিক্ষার্থীদের না দেখানো, কোচিং বাণিজ্য, গাইড বই বাণিজ্য, প্রাইভেট না পড়লে ইচ্ছাকৃতভাবে রেজাল্ট খারাপ করিয়ে দেওয়া, বেতন বকেয়া হলে লাঞ্ছিত করা, উপহার হিসেবে ফলমূল ও শাকসবজি নেওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অভিভাবক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফজলুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল আমিন ধুমকেতু, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হযরত আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রনি উল আলম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রিদওয়ানুল হক মুজাহিদ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষকের কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখে হতাশায় পড়েন কয়েকজন নিবেদিত শিক্ষক। বিভিন্ন অভিযোগ শুনে বিদ্যালয়টির জনপ্রিয় ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক বলে সর্বজন স্বীকৃত জাহাঙ্গীর আলম ও জনি আলমসহ আরও কয়েকজন শিক্ষককে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ অনুষ্ঠানটির লাইভ বন্ধ করে দেন এবং ভিডিও ধারণ করা থেকে সকলকে বিরত থাকতে বলেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দিতে এসে একজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি নিজেই একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুলশিক্ষক। এক মাসের বেতন ঠিক সময়ে দিতে না পারায় একজন শিক্ষক আমার মেয়েকে থাপ্পড় মেরে বলেছেন, তোর বাপ বেতন দিতে পারে না, স্কুলে কেন ভর্তি করেছে? একজন শিক্ষকের ব্যবহার এমন কেন হবে। আমার কি এ স্কুলের মাসিক বেতন সাড়ে বারও টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই? শিক্ষকের মধ্যে যদি নৈতিকতা না থাকে তবে তারা শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দেবে?
জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি লিটন বলেন, আমার মেয়ে বিজ্ঞানে কম নম্বর পাওয়ার পর আমাকে বলে, আমি প্রাইভেট পড়ি না বলেই আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দিয়েছে। তুমি তো আমাকে স্কুল টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়তে দাও না। এজন্যই আজ এ অবস্থা। পরবর্তীতে আমি শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ভুলে ৮৬ নম্বর পেলেও রেজাল্ট কার্ডে ৭৫ নম্বর উঠানো হয়েছে।
আরেক অভিভাবক মাহমুদা খাতুন বলেন, কয়েক মাস আগে নতুন প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে স্কুলে নিয়মিত সকল ক্লাস হচ্ছে এটা খুবই পজেটিভ। একই সঙ্গে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য যেন বন্ধ করা হয় আমি সেই দাবি জানাচ্ছি। একজন শিক্ষক যদি পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে শিক্ষার্থীদের একই সঙ্গে প্রাইভেট পড়াতে পারে এবং তাদের সকল খাতা দেখতে পারে, তবে শ্রেণিকক্ষে কেন পারবে না। প্রাইভেট পড়লেই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল ভালো হবে আর না পড়লে তাদের ফলাফল পেছনের দিকে থাকবে এ সংস্কৃতি দূর করতে হবে। এটা অনেকটাই এরকম প্রমাণের চেষ্টা করা, তোমরা আমাদের কাছে জিম্মি। তোমাদের সঙ্গে আমরা যা খুশি তাই করতে পারি।
চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সুমাইয়া অভিযোগ করে বলেন, প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষকরা ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। অনেক সময় অভিভাবকদের সঙ্গেও ফোনে খারাপ আচরণ করেন। এই বিদ্যাপীঠে মর্নিং শিফটে চলে পাঞ্জেরি গাইড আর ডে শিফটে চলে লেকচার গাইড। মূল বই কখনোই পড়ানো হয় না। শিক্ষকরা যাকে খুশি প্রথম বানাচ্ছে যাকে খুশি শেষ বানাচ্ছে। শিক্ষকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে জেলার শিক্ষার মান তলানিতে পৌঁছে গেছে। পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রতিবছর ৪০-৫০ জন ছাত্রছাত্রী মেডিকেলসহ বিভিন্ন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাচ্ছে। আর আমাদের মেহেরপুর জেলা থেকে দুই বা তিনজন চান্স পাচ্ছে তাও আবার বিভিন্ন ধরনের কোটার জন্য।
সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক বলেন, এ বিদ্যালয় শিক্ষকরা ঘুষ প্রবণ হয়ে গেছে। ছাত্রীরা এখন একটু ভালো নম্বর পাওয়ার আশায় শিক্ষকদের ফলমূল ও শাক সবজি গিফট করে। এগুলো শিক্ষকরা কেন নেবে? সকল অভিভাবকের তো এভাবে গিফট দেওয়ার ক্ষমতা নাই। এজন্যই কি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় কম নম্বর পাবে আর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে? আমি একটি দাবি জানাচ্ছি, কোনো শিক্ষক পরীক্ষার আগে যেন আর সাজেশন দিতে না পারে।
তিনি আরও বলেন, যারা শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেওয়ার কথা তারা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে না। শিক্ষার্থীর অভিভাবক শিক্ষার্থীকে স্কুলে দিতে এসে নিজ শরীরের পোশাক দিয়ে বেঞ্চ পরিষ্কার করে সন্তানকে বসিয়ে দিয়ে যায়।
অপর এক অভিভাবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। কিছুদিন আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমি আহত হয়েছিলাম, আর আমার স্বামী ঘটনাস্থলে নিহত হন। আমি ঢাকাতে চিকিৎসাধীন ছিলাম। সে সময় কোনো একটি কারণে স্কুলে একটি চাঁদা নির্ধারণ করা হয়। এটি না দিতে পারার কারণে আমার মেয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ব্যবহার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, আরেকটি বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি, এ স্কুলের শ্রেণিকক্ষগুলোতে ক্যাপ্টেনের একটি কালচার তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষকদের যতটুকু না ভয় পায়, তার চেয়ে শ্রেণিকক্ষ ক্যাপ্টেনদের বেশি ভয় পায়। অনেকটা যেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মত ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ কালচার দূরীকরণ সকলের প্রতি আকুল অনুরোধ জানাচ্ছি।
অভিভাবক শামসুজ্জামান রন্টু বলেন, আমি প্রথমেই অনুরোধ করব, আজকে যে সকল অভিভাবক বক্তব্য দিল তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত করা হয়। আমি নিশ্চিত আগামীকাল থেকেই এসব অভিভাবকের সন্তানদের উপর বিভিন্ন কৌশলে নিপীড়ন শুরু হবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্য আমি প্রধান শিক্ষক ও জেলা প্রশাসকের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত এই বিদ্যালয়টি কোনো শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছিল না, এটি ছিল একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বর্তমান প্রধান শিক্ষক আসার পর থেকে কিছুটা উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আশা করছি এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
শিক্ষার্থীদের পক্ষে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোজা বক্তব্য দিতে গিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে বক্তব্য রাখে। এরপরই রাখেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যুগ্ম-আহ্বায়ক রিদওয়ানুল হক মুজাহিদ ওই শিক্ষার্থীর আচরণের জন্য সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
সমাপনী বক্তব্যে মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. ফজলুল হক বলেন, আমি ভাবতেই পারিনি আমার ডাকে আপনারা এভাবে সাড়া দেবেন। আমি গত জুলাই মাসে এ বিদ্যালয়ে যোগদান করেছি। তারপর থেকেই চেষ্টা করে আসছি এখানকার অনিয়মগুলো দূর করতে। এ মাসের ১৬ তারিখ আমার চাকরির শেষ কর্মদিবস। আমি আশা করছি আমার পরবর্তীতে যিনি আসবে তাকেও আপনারা সহযোগিতা করবেন।
বিশেষ অতিথি মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল্লাহ আল আমিন ধুমকেতু বলেন, আমি এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হলেও আমি এখানকার একজন অভিভাবক। আমার মেয়ে এখানে পড়ে। আজকে অভিভাবকদের বক্তব্য শুনে আমি খুবই ব্যথিত। তবে একটা কথাই বলব এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান উন্নয়ন হয়নি। শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে হবে।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হযরত আলী বলেন, আমি নিজেও একজন শিক্ষক, আমার বাবা-মা দুজনেই শিক্ষক ছিলেন। আমার পরিবারের মোট ১২ জন সদস্য শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। আজ এখানে এসে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শুনে আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে, বিব্রতবোধ করছি। শিক্ষকরা যদি শিক্ষার্থীদের নিজের মেয়ে ভেবে মূল্যায়ন করে তবে এ ধরনের কোনো সমস্যা বা অভিযোগ ভবিষ্যতে থাকবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ বলেন, এখানে আমরা শিক্ষার মান উন্নয়নে করণীয় নিয়ে আলোচনা করতে অভিভাবক সমাবেশে সমবেত হয়েছি। আমাদের কাছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক সকলেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনেক অভিভাবক এখানে এমন কিছু অভিযোগ এনেছে যে ধরনের অভিযোগ আমি আগে কখনও শুনিনি। আজকে এখানে যে অভিযোগগুলো শুনেছি ভবিষ্যতে আর এ ধরনের কোনো অভিযোগ শুনতে চাই না।
তিনি আরও বলেন, আমি নিজেও চট্টগ্রামের একটি স্বনামধন্য সরকারি গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম। তাই বর্তমান পরিস্থিতি আমাকে ব্যথিত করছে। আমি আগেও এখানে একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। তখন আমার মনে হয়েছিল এ বিদ্যালয়ে ডিসিপ্লিনের অভাব রয়েছে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষককে অনুরোধ করব বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার। আর বাংলাদেশ সরকারের কোচিং সংক্রান্ত একটি নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালাটি মেহেরপুর জেলাতে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে আমি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে অনুরোধ করছি।
মন্তব্য করুন