বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে জালিয়াতি করে গত ১৫ বছরে প্রায় ১৫০০ একর জমির মালিক হয়েছেন মোহাম্মদ আলী সিকদার নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা। মোহাম্মদ আলী লামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত ১৫ বছরে মোহাম্মদ আলী ও তার ছেলে যুবলীগ নেতা দস্তগীর সিকদার মানিক মিলে জালিয়াতি করে অন্যের জায়গা নিজেদের নামে রেজিস্ট্রি করে জবরদখলের মহোৎসব চালিয়েছে। এখনও সরই ইউনিয়নের হাজারো কৃষক পরিবার তাদের কাছে জিম্মি। সর্বশেষ বিগত জুলাই-আগস্ট মাসের আগে দলীয় দাপট খাটিয়ে লামা সুয়ালক সড়ক জবরদখল করে সরই বাজারে মার্কেট নির্মাণ করেন মোহাম্মদ আলী সিকদার। লামা ভূমি অফিস, প্রশাসন থেকে শুরু করে সব জায়গায় তাদের দাপট চলে। যার কারণে চাইলেই যে কারো জমি অন্যজনকে দিয়ে রেজিস্ট্রি করে নিজেদের নামে নামজারি করে নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোহাম্মদ আলী সিকদার বিগত দিনে ১৯ বছর লামা সরই ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে। সেই সুবাদে এলাকার প্রায় প্রতিটি কৃষকের জায়গা জমি থেকে শুরু করে সবকিছু তার নখদর্পণে। প্রায় সকলের ছবি তার কাছে ছিল। সেই ছবি ও আগেকার তার স্বাক্ষরিত চেয়ারম্যান সনদ ব্যবহার করে ভুয়া আইডি কার্ড বানিয়ে ভূমি কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে মূলত সে জালিয়াতি করে অন্যের জমি নিজ ও পরিবারের নামে করে নেয়।
আরও জানা গেছে, চেয়ারম্যান থাকাকালীন মোহাম্মদ আলী দুর্নীতি করে কোটি টাকা আয় করেন। খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তবানদের কাছ থেকেও বিভিন্ন কৌশলে চাঁদাবাজি করে। এমনকি কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে কাজ করা দিনমজুর পুরুষ-মহিলাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৭০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। আবার সরকারি বেতন চালিয়ে এদের দিয়ে নিজ বাগানে কাজ করারও অভিযোগ রয়েছে।
এলাকাবাসী বলেন, এক সময় মোহাম্মদ আলীর একটা বিড়ি খাওয়ার টাকা না থাকলে ও শুধু চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। মোহাম্মদ আলী শুধু নিজেদের জমি নয় বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতাদের ও জমি জবরদখল দিয়েছে। বিশেষ করে সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের স্ত্রীকে প্রায় ৫০০ একর জমি চুক্তিভিত্তিক জবরদখল করে দিয়েছে।
এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বারবার লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো বিচার পান বলে জানান ক্ষতিগ্রস্তরা। তার জালিয়াতি ও জবরদখলের শিকার হয়ে অনেক দরিদ্র পরিবার বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যের আশ্রয়ে চলে গেছে। অনেকে আবার ভয়ে এলাকাছাড়া।
মোহাম্মদ আলীর জালিয়াতি ও জবরদখলের শিকার বৃদ্ধ সাহেব আলী তালুকদার বলেন, লামা সরই ইউনিয়নে আমার জায়গাটি মোহাম্মদ আলী কৌশলে জালিয়াতি ও জবরদখল করে নিয়ে নিয়েছে। আমার প্রায় ৩০ একর জমি জালিয়াতি করে মোহাম্মদ আলী ও তার পরিবারের লোকদের নামে করে নেয়। বিষয়টি আমি জানতাম না। পরে একদিন পাহাড়ি হাতি এসে আমার ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেয় ও স্ত্রীও হাতির আক্রমণে মারা যায়। পরে সেই বাড়ি মেরামত করতে গেলে মোহাম্মদ আলী গিয়ে জমিগুলো তার বলে দাবি করে এবং ঘর মেরামতে বাধা দেন। পরে আমাকে হত্যার হুমকি দিলে বসতবাড়ি ছেড়ে এখন খাগড়াছড়ি মেয়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছি।
মোহাম্মদ আলীর ষড়যন্ত্রের শিকার ছালেহা বেগম নামে এক বিধবা বলেন, মোহাম্মদ আলী ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সরকারি টাকায় আমার জমিতে বাধ দিয়ে পানি জমিয়ে মাছ চাষ করার প্রস্তাব দেয়। আমাকে জানানো হয়, মাছ বা পানি সবটাই আমা মালিকানায় থাকবে। সরকার গরিব কৃষকদের জন্য এটা ব্যবস্থা করেছে। জমিতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের ৬ মাস পর কে বা কারা আমা স্বামীকে মেরে রাস্তায় ফেলে রাখে। এর কিছুদিন পর ঘরে আগুন দেয়। এতে ঘরের সঙ্গে আমার সকল কাগজ ও দলিল পুড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, গত দুই বছর আগে মোহাম্মদ আলীর ছেলে দস্তগীর সিকদার মানিক একদিন ১২/১৩জন সন্ত্রাসী নিয়ে এসে বলে এসব জমি তাদের। আমাদেরকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলে। পরে আরও কয়েকবার হুমকি দেয়। আমরা বসতবাড়ি ছাড়তে না চাইলে রাতের আঁধারে সন্ত্রাসী নিয়ে এসে আমার মেয়ে ময়নাকে নির্যাতনের চেষ্টা চালায়। পরের দিন আমরা অন্যত্র চলে যাই।
ছালেহা বেগম বলেন, পরে জানতে পারি আমাদের জমিগুলো মোহাম্মদ আলী ও তার ছেলে অনেক আগে জালিয়াতি করে তাদের নামে রেজিস্ট্রি করে নামজারি করে নেয়। আমরা চলে আসার পর আমাদের জমিগুলো সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের কাছে ৭০ লাখ টাকা দিয়ে বিক্রি করে। বর্তমানে ছালেহা বেগমের আশপাশে আরও শতাধিক কৃষক মোহাম্মদ আলীর হামলার ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। কারণ তাদের জমিগুলোও মোহাম্মদ আলী নিজ ও পরিবারের লোকদের নামে জালিয়াতি করে নিয়ে নিয়েছে।
সরই বাজার এলাকার আরেক বাসিন্দা আছমা বেগম বলেন, ২০১৯ সালে আমার জমিতে ছেলেরা তিনটি পাকা দোকান নির্মাণ করে। দোকানে টিন দেওয়ার সময় হঠাৎ মোহাম্মদ আলীর ছেলে মানিক সিকদার একদল সন্ত্রাসী নিয়ে এসে দোকানে টিন লাগাতে বাধা দেয়। সে বলে জায়গাটি নাকি তার পরিবারের। মানিকের ভয়ে আছমা বেগম এখনও দোকানে টিন লাগাতে পারেনি। একই এলাকায় মোহাম্মদ হানিফ নামের আরেক কৃষকদের ধানের জমি তার বলে দাবি করে কয়েকবার জবরদখল করতে যায়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী কালবেলাকে বলেন, এসব মিথ্যা অভিযোগ। আমি এসব করিনি।
মন্তব্য করুন