টাঙ্গাইলে মিষ্টি পান চাষ করে বিপ্লব ঘটিয়েছেন জহুরুল ইসলাম নামে এক কৃষক। দারিদ্র্যকে পরাজিত করে পান চাষের ফলে তার সংসারেও ফিরেছে সচ্ছলতা। বর্তমানে জেলায় পানচাষিদের কাছে উদাহরণ হয়েছেন তিনি। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে তার পানের বরজ দেখতে আসেন উৎসাহী লোকজন।
জহুরুল টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার মামুদনগর ইউনিয়নের ভাতশালা গ্রামের মৃত সরব আলীর ছেলে। বাণিজ্যিকভাবে প্রায় এক বিঘা জমিতে পান চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার সফলতার কারণে অনেক কৃষক পান চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, টাঙ্গাইলের মাটি পান চাষের জন্য সম্ভাবনাময়। জহুরুলের দেখাদেখি অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এ ছাড়া নিয়মিত কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি বিভাগ।
আদিকাল থেকেই পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়নের রীতি চলে আসছে। সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিয়েসহ গল্পের আসরের সর্বশেষ পূর্ণতা মেলে পান-সুপারি আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে। এই পান বয়স্ক নারী-পুরুষের কাছে নিত্য অনুষঙ্গ। তাই পানের সুখ্যাতি ও চাহিদা মাথায় রেখে জহুরুলও নেমে পড়েন এ কাজে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জহুরুলের পানের বরজের প্রতি লাইনে সূর্যের আলোতে গাছে গাছে চকচক করছে সবুজ রঙের ছোট-বড় আকারের পানের পাতাগুলো। সেই বাগানের চারপাশে নেটের জাল দিয়ে বেষ্টনী করে রেখেছেন তিনি। প্রতিটি পানগাছ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য একটি করে শোলা ব্যবহার করা হয়েছে। তার সঙ্গে শোলা ও বাঁশ দিয়ে মাচার মতো করে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, অভাব-অনটনের সংসারে অন্যের দোকানে দর্জির কাজ করে সংসার চলে কৃষক জহুরুলের। পাঁচ বছর আগে রাজশাহীতে বেড়াতে গিয়ে পানবাগান পরিদর্শন করেন তিনি। এরপর পান চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা নেন। পরে এক বন্ধুর পরামর্শে সেখান থেকে প্রথমে পাঁচ হাজার মিষ্টি জাতের পানের চারা কিনে বাড়ির পাশের পালান উঁচু ভিটে বাড়িতে ২৫ শতাংশ জমিতে পরীক্ষামূলক পান চাষ করেন। মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় প্রথম বছরেই সফলতার মুখ দেখেন তিনি।
জহুরুলের সফলতা দেখে পান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেক কৃষক। তাদের মধ্যে ভাতশালা গ্রামের জয়নুল আবেদিনও একজন। তিনি বলেন, জহুরুল প্রথম যখন পানের চাষ শুরু করেন, তখন গ্রামের অনেক মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আমাদের নাগরপুরে বেশিরভাগ জায়গা নিচু, তাই ধান ও ভুট্টা আবাদ বেশি হয়। তারপরও এই পানের চাষ উঁচু জায়গায় করতে হবে। এখন আমিও ভাবছি আমার বাড়ির পালানে পান চাষ শুরু করব। জহুরুলের মতো আরও উদ্যোক্তা তৈরি হলে নাগরপুরের পানের চাহিদা অনেকটা পূরণ হবে।
একই এলাকার নাসির উদ্দিন বলেন, জহুরুলের মিষ্টি পানের চাষে এখানকার পানভোগীরা বেশি আকৃষ্ট। অন্যান্য জাতের পানের চেয়ে তার পান মিষ্টি ও সুস্বাদু। তাই স্থানীয় পানভোগীরাসহ ব্যবসায়ী ও দোকানিরা জহুরুলের পান কেনার জন্য সকাল-সন্ধ্যায় আসতে থাকেন। কিন্তু তাদের চাহিদা অনুযায়ী তিনি পান দিতে পারেন না। কারণ কিছুদিন আগে বৃষ্টিতে পানের বেশ ক্ষতি হয়েছিল। ফলে পান নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে নতুন নতুন পান গজাতে থাকলে আশা করা যাচ্ছে অল্পসময়ের মধ্যে জহুরুল সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।
সফল পানচাষি জহুরুল ইসলাম জানান, নাগরপুর উপজেলায় তিনিই প্রথম রাজশাহীর মিষ্টি পানের চাষ শুরু করেছেন। তার বাগানে কোনো সমস্যা দেখা দিলে রাজশাহীর চাষিদের পরামর্শ নেন। আশা করছেন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লাভের পরিমাণ আরও বাড়বে। এ বছর ঝড় ও টানা বৃষ্টিতে বরজের প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। বেশকিছু পানগাছও মারা গেছে। পোকার উপদ্রব ঠেকাতে ওষুধ ছিটানো ছাড়া অতিরিক্ত কোনো খরচ নেই বলে পান চাষ লাভজনক।
জহুরুল কালবেলাকে বলেন, আমার এই পান বাগানে দুই বছরে সব মিলে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। অন্যদিকে এই বাগান থেকে তিন লক্ষাধিক টাকা উপার্জনও হয়েছে। এ ছাড়া বাগানে তিন লক্ষাধিক টাকার পান বিক্রি করার মতো হয়েছিল। সেই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাগানে বেশ ক্ষতি হয়েছিল। তার পরও আমি আশা করছি যে পরিমাণে গাছে পান আসছে, তাতে এ বাগান থেকে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে চার লক্ষাধিক টাকার মিষ্টি পান বিক্রি করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, আমি দরজির কাজের পাশাপাশি এই পান বাগান দেখাশোনা করি। এখানে সময় দিয়ে মনে হলো পান বাগান থেকে আমার বড় একটি পুঁজির সংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে জেলায় ৫৬ একর জমিতে পানের আবাদ হয়েছে। গত বছর জেলায় পানের উৎপাদন ছিল ১৫৮ টন। গড়ে হেক্টরপ্রতি সাত টন, যা আশানুরূপ ফলন। জেলায় বর্তমানে ভেরামারা ও এলসি জাতের পান চাষ হচ্ছে। চাষিদের নানাভাবে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন কৃষকদের পান চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন তারা।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল খামারবাড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আশেক পারভেজ কালবেলাকে বলেন, চলতি বছরে জেলায় ৫৬ একর জমিতে পানের বরজ করা হয়েছে। নতুন কৃষক পান চাষে উদ্বুদ্ধ হলে জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের চাহিদা পূরণেও ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আরও বলেন, টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধনবাড়ির কিছু অংশে এবং নাগরপুরের একটি এলাকায় পানের চাষ হচ্ছে। পান একটি অর্থকরী ফসল। তাই নতুন কোনো পানচাষি পেলে তাদের ওপর আমরা বিশেষ নজর দিয়ে থাকি। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের মাটি পান চাষের জন্য উপযোগী। এ ক্ষেত্রে নতুন চাষিদের জন্য আমরা সহজলভ্য ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
মন্তব্য করুন