চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালায় মেঘনা নদীতে জাহাজ থেকে ৭ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় মামলা করেছেন জাহাজ মালিক মাহাবুব মুর্শেদ। এতে সাক্ষী রয়েছেন ৯ জন।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাতে হাইমচর থানার ওসি মহিউদ্দিন সুমন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, গত ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে ২৩ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার যে কোনো সময়ে ঈশানবালার মনিপুর টেক খাল পাড় সংলগ্ন এলাকায় খুনের ঘটনাটি ঘটে। এর আগে এমডি আল বাখেরা কার্গো জাহাজের মাস্টার কিবরিয়া গত ১৯ ডিসেম্বর বিকাল ৪টার সময় চট্টগ্রামের অগ্রাবাদের সমতা শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং এজেন্সির হিসাবরক্ষক টিপুর কাছ থেকে জাহাজের কর্মচারীদের খোরাকি বাবদ নগদ ৩০ হাজার টাকা নেন। পরে গত ২২ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় কার্গো জাহাজ ‘এমডি আল বাখেরা’ চট্টগ্রাম কাফকো জেটি থেকে ইউরিয়া সার বোঝাই করে ৯ কর্মচারী নিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার বাঘাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করে। ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ২২ মিনিটের সময় এমভি আল বাখেরার ড্রাইভার সালাউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জাহাজের অবস্থান হাতিয়া পাড় হয়ে চরগজারিয়ার কাছে থাকার খবর পায়। পরের দিন অর্থাৎ ২৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় খবর নিতে গেলে কল দিয়ে ফোন বন্ধ পেলে এ ঘটনা ধীরে ধীরে সামনে আসে।
জাহাজ মালিক মাহাবুব মুর্শেদ বলেন, আমাদের জাহাজটির ৬ মালিকের মধ্যে আমিও একজন। আমি ঢাকা দোহারের সুতার টেক গ্রামের বাসিন্দা। আমি চাই যে বা যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। আমি ন্যায়বিচার চাই।
স্থানীয়রা বলছেন, মনিপুর টেক জায়গাটিতে এর আগেও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সে সব ঘটনায় এমন নৃশংস বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড নেই। তবে নৌপথের ওই রুটটি অনেকটাই অনিরাপদ। তবুও এখান দিয়ে কোটি কোটি টাকার মালামাল নিয়ে পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করছে। তাই দ্রুত রহস্য উন্মোচন ও দোষীদের আইনের আওতায় আনা হোক।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জাহাজটিতে পাইলট ছিল না। এমনকি তাতে স্কট, সিসি ক্যামেরা, ভিএইচএফ যন্ত্রপাতিও ছিল না। সেক্ষেত্রে জাহাজটি কীভাবে এতদিন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নদীতে চলাচল করেছে? সে নিয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে দুষছেন অনেকে।
যদিও অবৈধ রেজিস্ট্রেশনবিহীন কার্গো জাহাজের বিরুদ্ধে প্রায়ই জরিমানাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌযান পরিবহনের চাঁদপুর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক শ. আ. মাহফুজ উল আলম মোল্লা। তিনি বলেন, ঘটনার খবর শুনেই ঘটনাস্থলে যাই। পরে দেখলাম জাহাজটি নোঙর করা ছিল না বরং চরে আটকে ছিল। ওটাতে পাইলটও ছিল না। যার কারণে নির্দিষ্ট কেনেলের বাইরে দেখতে পাই জাহাজটি। ওই জাহাজটির আকার অনুযায়ী কমপক্ষে ১২ জন থাকার কথা কিন্তু বাকিরা আদৌ ছিল কিনা তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
এদিকে দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে শত শত নেতাকর্মী নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নৌযান ধর্মঘট ডাক দেওয়ার আলটিমেটাম দেন নৌযান শ্রমিক ফেডারশনের নেতা মো. হারুন।
তিনি বলেন, ওই জাহাজে কমপক্ষে ১১ জন থাকার কথা। ৮ জনের তথ্য পেলে বাকি লোক কই? এছাড়া যারা নিহত হয়েছেন প্রত্যেককে ২০ লাখ করে টাকা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন এবং প্রতিটি জাহাজের নিরাপত্তার দাবি জানান তিনি।
হাসপাতালে থাকা জুয়েল সুস্থ হতেই অনেক তথ্য দেওয়া শুরু করেছে বলে জানান চাঁদপুর অঞ্চলের নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, অনিরাপদ নয় বরং পরিকল্পিতভাবে জাহাজে অবস্থান নিয়েই প্রত্যেককে নেশা জাতীয় দ্রব্য বা ঔষুধ খাইয়ে ঘুমের ঘোরে রেখে খুন করা হয়েছে ধারণা করছি। ঢাকায় চিকিৎসাধীন জুয়েল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে যার নাম পেয়েছি তিনি সেদিন ছুটিতে ছিলেন বলে খবর পাচ্ছি। হয়তো প্ল্যানারদের প্লান ছিল সবাইকে মেরে চাঁদপুরের ওই রুটে মাল খালাস করবে। অনেক তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। হয়তো দ্রুত রহস্যময় এ খুনগুলোর সমাধান চলে আসবে।
তিনি আরও বলেন, রক্তমাখা ওই চায়নিজ কুড়াল, ৪টি মোবাইল, ছুরি সব কিছুর ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার কাজ অব্যাহত আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এ ঘটনার মাস্টার মাইন্ডকে আমরা ধরে ফেলতে পারব বলে প্রত্যাশা করছি। তবে মালিকদের মধ্যে ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব কিংবা আহত জুয়েলেরও কোনো নাটকীয়তা আছে কিনা সব কিছুই ছায়া তদন্তে নজরদারি চলছে।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায় বলেন, লোমহর্ষক ক্লুলেস ওই সেভেন মার্ডারের ঘটনায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্তের স্বার্থে জেলা পুলিশের ৩ সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠিত হয়েছে। যারা আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
এদিকে শ্রম মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের পর জেলা প্রশাসনও ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তিনি বলেন, আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যেই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছি। এছাড়াও আমরা আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার এবং নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকার চেক দিয়েছি।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের মেঘনা নদীর ঈশানবালায় আল বাখারা নামক জাহাজে চালকসহ সাতজনকে কুপিয়ে নির্মমভাবে খুন করা হয়। ওই ঘটনায় নিহতরা হলেন- জাহাজটির মাস্টার গোলাম কিবরিয়া (৬৫), লস্কর শেখ সবুজ (৩৫), সুকানি আমিনুল মুন্সী, লস্কর মো. মাজেদুল (১৬), লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬), ইঞ্জিনচালক মো. সালাউদ্দিন (৪০) এবং বাবুর্চি কাজী রানার (২৪)। এছাড়াও জুয়েল নামে একজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
মন্তব্য করুন