শিক্ষানগরী হিসেবে রাজশাহীর খ্যাতি দেশজুড়ে। কিন্তু এই শিক্ষানগরীর ছাত্রীনিবাসগুলোতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ছাত্রী নির্যাতন, নিম্নমানের খাবার পরিবেশনসহ বিভিন্ন অত্যাচারের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। কিন্তু মেস মালিকদের এমন নির্যাতন দিনের পর দিন মুখ বুজে সহ্য করেই চলেছেন রাজশাহীর বিভিন্ন ছাত্রীনিবাসে থাকা ছাত্রীরা।
তবে হঠাৎ রোববার (২২ ডিসেম্বর) রাজশাহীর একটি ছাত্রীনিবাসে নিম্নমানের খাবারের পরিবেশনের প্রতিবাদ করায় এক ছাত্রীকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, এর প্রতিবাদ করায় দিনভর ছাত্রীদের ওই ছাত্রীনিবাসে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনাও ঘটেছে।
পরে এর প্রতিবাদে রোববার গভীর রাতে ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে নগরীর বোয়ালিয়া থানায় গিয়ে অভিযুক্ত ছাত্রীনিবাসের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় মালিক ও তার দুই ছেলেকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজশাহীতে পড়তে আসা ছাত্রীরা যাতে ছাত্রীনিবাসের মালিকদের দ্বারা আর নির্যাতনের শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে জোর দাবি জানিয়েছেন রাজশাহীর সুশাসন ও মানবাধিকার বিশ্লেষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের কাদিরগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত এই ছাত্রীনিবাসটির নাম ‘ঝলক-পলক মেস’। ছাত্রীনিবাসটিতে প্রায় ৩০০ ছাত্রী থাকেন। গত রোববার বেলা ১১টার দিকে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করায় এক ছাত্রী এর প্রতিবাদ জানায়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে মেসের মালিকের দুই ছেলে ঝলক ও পলক। এর প্রতিবাদ করায় দিনভর ছাত্রীদের ছাত্রীনিবাসে অবরুদ্ধও করে রাখা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে পুলিশ গিয়ে দুজনকে আটক করে। পরে ছাত্রীনিবাসের মালিককেও আটক করা হয়।
ছাত্রীনিবাসে ছাত্রীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন অমানবিক ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীরা রোববার রাত সাড়ে ১২টায় একযোগে ছাত্রীনিবাস থেকে বের হয়ে থানায় যান। মিছিল থেকে তারা বিচার চেয়ে নানা স্লোগান দেন। থানায় গিয়ে ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ছাত্রীনিবাসের মালিকসহ চারজনের নামে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ইতোমধ্যেই আটক তিনজনকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
ওই মেসের ছাত্রীরা জানান, তাদের বেশির ভাগ ছাত্রীই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির প্রস্তুতির জন্য এই ছাত্রীনিবাসে আছেন। এই ছাত্রীনিবাসে টাকা বেশি নেওয়া হলেও খাবারের মান খুবই খারাপ। রোববার সকালে নিম্নমানের খিচুড়ি পরিবেশনের প্রতিবাদ করেন এক ছাত্রী। তিনি এই ছাত্রীনিবাসে থাকবেন না বলে জানিয়ে দেন। এ সময় মালিকপক্ষ ওই ছাত্রীকে জানায়, ছাত্রীনিবাসে ওঠার সময় তিনি যে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন সেখানে আছে যে ৭ মাসের আগে ছাত্রীনিবাস ছাড়া যাবে না। ওই ছাত্রী চুক্তিপত্র দেখতে চাইলে মালিক জানান, আইনজীবী ছাড়া এটা দেখা যাবে না।
ছাত্রীরা আরও জানান, নিজের স্বাক্ষর করা চুক্তিপত্র দেখতে আইনজীবী লাগবে কেন, এমন প্রশ্ন তুললে ছাত্রীনিবাসের মালিক ওই ছাত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। মালিকের দুই ছেলে ঝলক ও পলক এসে ওই ছাত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এতে অন্য ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে ঝলক ও পলক তার বন্ধুদের নিয়ে গিয়ে ছাত্রীদের হুমকি দেন যে, তারা তাদের রাজশাহীতেই থাকতে দেবেন না।
ছাত্রীদের অভিযোগ, সকালের ওই ঘটনার পর মালিকপক্ষ দিনভর তাদের ছাত্রীনিবাসে অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাদের বলা হয়, রাতে ফটকের তালা খুলে দেওয়া হবে। তখন সবাইকে একযোগে ছাত্রীনিবাস ছাড়তে হবে। তখন ছাত্রীরা ফোন করে তাদের বন্ধুদের সহযোগিতা চান। এরপর রাত ১১টার দিকে ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মী গিয়ে ছাত্রীনিবাসের তালা ভেঙে ছাত্রীদের বের করেন। খবর পেয়ে সেখানে যান নগরের বোয়ালিয়া থানার ওসি মেহেদী মাসুদ। তিনি ছাত্রীনিবাস থেকে দুজনকে আটক করে নিয়ে যান। এ সময় তিনি মামলা করার জন্য ভুক্তভোগী ছাত্রীদের থানায় ডেকে আসেন। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে থানায় যান। ভুক্তভোগী ছাত্রী মামলা করার পর রাত ২টার দিকে তারা থানা থেকে বের হন।
বোয়ালিয়া থানার থানার ওসি মেহেদী মাসুদ কালবেলাকে বলেন, ‘খবর পেয়েই সেখানে পুলিশ গিয়ে দুজনকে আটক করে। পরে পুলিশের পরামর্শে ছাত্রীরা চারজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন। আটককৃত তিনজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।’
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (বোয়ালিয়া জোন) মো. মতিয়ার রহমান বলেন, ‘খাবারের মধ্যে বালি-কিংবা পাথর ছিল। এ নিয়ে এক ছাত্রী প্রতিবাদ করলে ছাত্রীনিবাসের মালিক ও তার দুই ছেলে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে ফিজিক্যালি অ্যাসল্ট করে। পরে মালিক ও তার দুই ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, রাজশাহীতে অনেক মেস। এটা আমাদের মাথাতেই আসেনি যে, স্টুডেন্টরাও এ রকম থ্রেটের মুখে থাকে। এটা এখন আমাদের নলেজের মধ্যে আসল। আমরা সজাগ থাকব। এছাড়া আরও যদি কোনো ঘটনা থেকে থাকে বা ঘটে থাকে বা ভবিষ্যতে ঘটকে সঙ্গে সঙ্গেই যেন পুলিশকে তারা জানায়। আমরা যত দ্রুত সম্ভব আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এদিকে রাজশাহীর ছাত্রীনিবাসগুলোতে ছাত্রীদের নির্যাতনের এমন ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি কাদিরগঞ্জেরই শাহেদা টাওয়ার নামে এক ছাত্রীনিবাসে ছিলাম। সেখানকার মালিকও ক্যারেক্টার লেস ছিল। কোনো কারণ ছাড়াই ছাত্রীদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিতো। সুন্দরী মেয়েদেরকে তার গোপন একটি কক্ষে ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়ে যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন খারাপ কর্মকাণ্ড করতো। পরে বিষয়টি বুঝতে পেরে ওই মেস থেকে আমি বের হয়ে অন্য মেসে চলে যাই। রাজশাহীর প্রায় সব ছাত্রীনিবাসের চিত্রই এমন।
সুশাসন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মী সুব্রত কুমার পাল বলেন, ‘শিক্ষানগরী রাজশাহীতে যত্রতত্রই আইন কিংবা নিয়ম না মেনে মেস হয়েছে। প্রথমত এগুলো বন্ধ করতে হবে। একটি মানসম্মত মেস তৈরির সূচকগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আগে নিশ্চিত করত হবে। এই সূচকগুলো চিহ্নিত করা মানবাধিকারের অংশ। এর আগেও শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এজন্য অবশ্যই আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মেস মালিকপক্ষ ও সেখানে যারা থাকেন তাদের মধ্যে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। রাত ১২টার দিকে যেখানে ছাত্রীদের নিরাপদ আবাসে থাকার কথা সেই সময়ে মেস মালিকের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে মামলা করা কিংবা রাস্তায় নামা বর্তমানে এটি খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা চাই না, এমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটুক।’
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষানগরী রাজশাহী শান্তিপ্রিয় জন্যই এখানে অভিভাবকরা ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য রাজশাহীতে পাঠায়। এখানে মেস মালিক ও বখাটেদের কারণে ছাত্রীদের নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। খাবারের গুণগত মানও খুবই খারাপ। দীর্ঘদিন থেকে আমরা এমন আচরণই দেখে আসছি। প্রশাসনের নাকের ডগায় এই আচরণগুলি ঘটলেও কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই গতকাল রোববার এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
মন্তব্য করুন