সুন্দরবন উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রা। এই উপজেলায় প্রায় দুই লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস। এলাকায় তেমন কর্মক্ষেত্রও না থাকায় অধিকাংশ মানুষ জীবিকার তাগিদে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। মাছ-কাঁকড়া, মধু আহরণ, গোলপাতা আহরণসহ নানা ধরনের পেশার সঙ্গে জড়িত এ উপজেলার মানুষ।
গত কয়েক বছর সুন্দরবনে বনদস্যুদের উৎপাত কমছিল। কিন্তু সম্প্রতি সুন্দরবনে আবারও বনদস্যুদের উৎপাত বেড়েছে। মাছ ধরতে যাওয়া জেলে-বাওয়ালিদের জিম্মি করে মুক্তিপণ নেওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের শের আলী মোল্যার ছেলে ইমদাদুল হক, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রামের নাজির সরদারের ছেলে রেজাউল ইসলাম ও গোলাম মোস্তফার ছেলে সুজন গাজীকে সুন্দরবনের ফিরিঙ্গি নদীর মোল্যাখালী খাল থেকে বনদস্যুরা অপহরণ নিয়ে যায়। পরে জিম্মি জেলেদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ দাবি করে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের এখনও মুক্তি মেলেনি।
২ নম্বর কয়রা গ্রামের জেলে শাহাদাৎ হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, আমরা নৌকা সাজিয়ে পাস নিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাই। তখন শিবশা এলাকায় আমাদের সঙ্গে ডাকাতদলের দেখা হয়। তারা আমাদের নৌকা থেকে একজনে উঠিয়ে নেয়। পরে মুক্তিপণ দাবি করে, আমরা পুনরায় বাড়িতে ফিরে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণের ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনি। পরে আর সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাইনি। এখন পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
গত ১৫ দিন আগে কয়রার রাসেল ও খায়রুল ইসলাম নামের দুই জেলেকে নিশিনখালী এলাকা থেকে অপহরণ করে সাগর বাহিনী নামের বনদস্যুদল। অপহরণের পর তাদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে ৯০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে বলেন, সুন্দরবনে আগের মতো বেশ কয়েকটি বনদস্যু (ডাকাতদল) সক্রিয় হয়েছে। এখন আর আগের মতো মাছ-কাঁকড়া হয় না, কিন্তু সুন্দরবনে গেলে তাদের টাকা দিতে হবে। টাকা দিতে না পারলে দীর্ঘদিন আটকে রেখে অমানুষিক ও শারীরিক নির্যাতন করে থাকে। এই ভয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছি না। তবে এলাকায় তেমন কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব এলাকায় প্রশাসনের নজরদারি কমে যাওয়ার কারণেই সেখানে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী এবং আলিফ ওরফে দয়াল বাহিনী, সাগর বাহিনী-আলম ওরফে পাটওয়ারী বাহিনী পশ্চিম সুন্দরবন, খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের সময় কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া কিছু বন্দিও এই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, সুন্দরবনের নলবুনিয়া, খাঁশিটানা, বজবুজিয়া, মোল্লাখালী, মার্কি, নিশিন খালী, খড়কুড়িয়া, মান্দারবাড়িয়া, আড়ুয়া শিবসা, আদাঁচাই, পাতকোষ্ট, গেওয়াখালী ভোমরখালী, আন্ধার মানিক, নীলকমল, কাগা-দোবেকী, হংসরাজসহ খুলনা রেঞ্জের অধিকাংশ জায়গায় জলদস্যুদের উপস্থিতি রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৪-৫ মাসে পশ্চিম সুন্দরবনে অন্তত ১০টির ও বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত ৮ নভেম্বর কয়রা উপজেলার দুই মৎস্যজীবী আতাহার হোসেন ও রফিকুল ইসলামকে অপহরণ করা হয়। ডাকাতদল নিজেদের দয়াল বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে অপহরণ করেছিল তাদের। এরপরে তাদের পরিবারের কাছে চার লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। সেই টাকা পাওয়ার পর তাদের মুক্ত করে দেয় বনদস্যুরা ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩২টি দলের ৩২৮ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করে। তারা ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২,০২৪ রাউন্ড গোলাবারুদ হস্তান্তর করে। আত্মসমর্পণের পর অনেক দুষ্কৃতকারী সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় আর্থিক সহায়তাও পেয়েছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত নজরদারির অভাবের কারণে এই দুষ্কৃতিকারীদের মধ্যে অনেকে আবারও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ফিরে এসেছে। তারা জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে। যার ফলে সুন্দরবনের ওপরে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা জেলে-বাওয়ালি ও মৌয়ালদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
কোস্টগার্ডের কয়রা স্টেশনের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার মো. শাহ আলম বলেন, আমরা দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত টহল, অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রেখেছি যাতে জেলে বাওয়ালি সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মাছ ধরতে পারে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো কালবেলাকে বলেন, আমাদের কাছে বনদস্যুর বিষয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু তথ্য আসছে। আমরা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করব। আমরা চেষ্টা করছি সমন্বিতভাবে কাজ করতে, যাতে বনদস্যুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
২০১৮ সালে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ সরকার। সম্প্রতি ফের বাংলাদেশের অন্তর্গত সুন্দরবনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে দস্যুদল। অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি এবং সহিংস ডাকাতির ঘটনার বেড়ে যাওয়ায় আবার এই অঞ্চলটি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় এলাকায় নজরদারি বাড়ানো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
মন্তব্য করুন