গাইবান্ধা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ গ্রাহকরা আবেদন করতে এলে বেশিরভাগ সঠিক আবেদনেরও বিভিন্ন ত্রুটি ধরা হয়। আর এই ত্রুটির ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে বিশান চন্দ্র রায় নামের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা অভিযোগ করে বলেন, শুধু বিশান চন্দ্রই নন, এই পাসপোর্ট অফিসের বেশ কিছু কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে দালাল চক্রের সঙ্গে। কোন আবেদন গ্রহণ করা হবে, এ জন্য আগে আবেদনপত্রে নির্দিষ্ট চিহ্ন দেওয়া থাকে। এটি ধরেই কাজ করেন অফিস কর্মচারীরা। এ ছাড়া ফিঙ্গার প্রিন্টের নামে ঘুষ না দিলেই ভোগান্তিতে পড়তে হয় সেবাগ্রহীতাদের।
তারা আরও অভিযোগ করেন, সঠিক আবেদন নিয়ে গেলে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর বিশান চন্দ্র রায় ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য বাড়তি ১৫০০ টাকা করে ঘুষ দাবি করেন। এই টাকা না দিলে ১০ থেকে ১৫ দিন অপেক্ষা করিয়ে হয়রানি করেন তিনি। আবার যাদের কাছে বিশান টাকা চান না, তারা শরণাপন্ন হন অফিসের ভেতরে থাকা আনসার বাহিনীর সদস্য কিংবা অফিসের বাইরে থাকা কম্পিউটার দোকানের দালালদের।
সেবাগ্রহীতারা জানান, পাঁচ বছর মেয়াদে সাধারণ পাসপোর্টের খরচ হয় ৪ হাজার ২৫ টাকা, দালালরা নেয় ৭ হাজার টাকা। ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। দালালরা নেয় ৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া জরুরিভাবে পাঁচ বছর মেয়াদি ৬ হাজার ৩২৫ টাকার পরিবর্তে ৯ হাজার টাকা এবং ১০ বছরের ৮ হাজার ৫০ টাকার পরিবর্তে দালালরা নেয় ১০ হাজার টাকা। এসব টাকা না দিলে বেশিরভাগই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এতে প্রতি পাসপোর্টে প্রায় দেড় থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এই অফিসে প্রতিদিন দেড় শতাধিক মানুষ আবেদন নিয়ে এলেও জমা হয় মাত্র ৭০ থেকে ৮০টি আবেদন।
সরেজমিন দেখা যায়, পাসপোর্ট করতে আসা সেবাগ্রহীতারা বাইরে থেকে অনলাইনে আবেদন করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে এলেও ফিঙ্গার প্রিন্ট, পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসহ এনআইডি কার্ড ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের সনদের ভুল দেখিয়ে যাচাই-বাছাইকারী কর্মচারীরা আবেদন ফিরিয়ে দেন। অথচ একই আবেদন কম্পিউটারের দোকানদার দালাল হাবীব, আশিক, সৌরভ, শাহিন, মোরছালিন ও আনসার সদস্য শহিদুলের মাধ্যমে গেলে আবেদন গ্রহণ করেন বিশান চন্দ্র রায়সহ অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মুরতাজ। পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসে আট ধরনের সেবা পাওয়া যায়। এসব সেবা হলো ই-পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ, ই-পাসপোর্টের আবেদন যাচাই-বাছাই, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি যাচাই, আবেদন অনুমোদন, এনরোলমেন্ট সম্পন্ন করা, পুলিশি তদন্তসাপেক্ষে পাসপোর্ট প্রিন্টে প্রেরণ, রি-ইস্যু ও সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আপলোড এবং প্রিন্ট করা পাসপোর্ট বিতরণ। তিন নিয়মে পাসপোর্ট করা হয়౼একটি হলো সাধারণ, আরেকটি জরুরি ও অন্যটি অতি জরুরি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিস একটি হলেও পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ২৬টি কম্পিউটার দোকান। বেশকিছু দোকান থেকেই দালাল চক্রের সদস্যরা তাদের কার্যক্রম চালায়। এ সময় প্রকাশ্যে হয়রানির ছবি তুলতে গেলে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে দালাল হাবীব, আশিক, সৌরভ, শাহিন, মোরসালিনসহ বেশ কয়েকজন পাসপোর্ট অফিসের সামনে গ্রাহকদের হয়রানি করে প্রতিদিন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি দুদক অভিযান চালিয়ে সোহেল, রুবেল ও কাঞ্চনকে আটক করে। পরে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আবার দালালি চালিয়ে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগী সাইফুল মিয়া অভিযোগ করে বলেন, বিশান চন্দ্র ঘুষ ছাড়া সঠিক আবেদন ফেরত দেন না। আমি তাকে ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়েছি। তারপর কাজ হইছে। প্রথমে এই টাকা না দেওয়ায় সাত দিন ঘুরিয়েছেন তিনি।
পাসপোর্ট সেবা নিতে আসেন হজযাত্রীর স্বজন আব্দুল আরিফ। তিনি বলেন, সঠিক আবেদন নিয়ে এলেও বিভিন্ন অজুহাতে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন এখানকার কর্মচারীরা। এতে বৃদ্ধ মানুষকে নিয়ে হয়রানিতে পড়লাম। তাদের বললেও কোনো কথা কানে নেন না।
জানতে চাইলে দালাল চক্রের সদস্য মোরছালিন মিয়া কালবেলার এই প্রতিবেদককে তার সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দিয়ে বসে। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক ভাই, এখানে আমার দু-একটি কাজ করে দেবেন, আপনিও ভাগ পাবেন। এখানে তো সাংবাদিকরাও এসে কাজ করে। দিনে পাঁচটি কাজ করলে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পাবেন। আমারও দু-একটা কাজ করে দেন। সাংবাদিকরা ভেতরে গেলেই কর্মচারীরা কাজ করে দেন খুব তাড়াতাড়ি।
তার কথা শুনে সাধারণ সেবাগ্রহীতা সেজে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য রওনা দিই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে আনসার বাহিনীর সদস্য শহিদুল মিয়া পথরোধ করে বলেন, কোথায় যাচ্ছেন? কী করবেন? এসব বলেই তিনি আমাকে পাশে নিয়ে গিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করে দেওয়ার কথা বলে অতিরিক্ত ২ হাজার টাকা চান। পরে পাসপোর্ট করতে চাইলে ফোন নম্বর হাতে ধরিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।
তবে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, পাসপোর্ট অফিস এখন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এর আগে দুদক অভিযান চালিয়ে তিন দালালকে আটক করলেও, এই অফিসের দালালি কোনোভাবেই কমছে না বরং আরও বেড়েছে। সবসময় পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে থাকে দালালদের পদচারণা। এসব দালাল থেকে দ্রুত হয়রানিমুক্ত পাসপোর্ট সেবার দাবি জানাচ্ছি।
দালালদের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও সেবাগ্রহীতাদের হয়রানির অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর বিশান চন্দ্র রায় কালবেলার কাছে অর্থ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। এ সময় এসব ভুয়া অভিযোগ বলে দাবি করেন তিনি।
আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি। তবে বলেন, যেহেতু অফিসের কর্মচারীদের বিষয়, তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ ছাড়া কোনো বক্তব্য দেবেন না তিনি।
মন্তব্য করুন