শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিলাশপুর এলাকার কৃষক রমিজ মিয়া তার ছেলে সুজন আলীকে দুবাই পাঠাবেন। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে এসেছেন পাসপোর্ট অফিসে। কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারেন বাবা-ছেলে দুজনের নামে ভুল আছে। এমন বিপাকের মধ্যে আবার পড়েছেন দালালের খপ্পরে। দালালের প্রস্তাবে তিনি এখন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন।
কী হয়েছে, জানতে চাইলে রমিজ মিয়া দৈনিক কালবেলাকে অভিযোগ করে বলেন, ‘বাবা, গ্রামের একজনে কইল সব মিলায়া ৫ হাজার টাকা হইলেই আপনার পোলার পাসপোর্ট হয়ে যাবে। কিন্তু অহন আবেদন করতে গিয়া দেহি আমার ও পোলার দুজনের ভোটার কার্ডে নাম ভুল। এহন এইডা ঠিক কইরা পাসপোর্ট করতে নাকি ৫০ হাজার টাকা লাগব। হেরা আবার আমারে কইছে, আমনের কাজ করুম কিন্তু আমার নাম-পরিচয় কারও কাছে কইতে পারবেন না। নাম কইলে আমনের পোলার পাসপোর্ট জিন্দেগিতেও হইব না।’
শুধু রমিজ মিয়া নন, ডামুড্যা উপজেলার সৌদিপ্রবাসী মো. মনিরুল ইসলামের স্ত্রী শারমিন জাহান সুইটি বলেন, আমার জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মনিবন্ধনে আমার নামের একটু গরমিল থাকায় মহসিন নামের এক দালাল আমার কাছ থেকে তিন কিস্তিতে মোট ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। পরে আমার হাতে পাসপোর্ট দিয়ে বলে, ‘আপনার কাজ করে আমার লাভ হয়নি। কারণ আপনার কাছ থেকে যা নিয়েছি, তা বিভিন্ন দপ্তরের টেবিলে দিতে দিতে শেষ।’ পরে সে আরও দাবি করে।
সারা দেশের মতো শরীয়তপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও অফিসের আশপাশের চিত্র নতুন কিছু নয়। পাসপোর্ট অফিসকে কেন্দ্র করে ছদ্মবেশী দালাল চক্র ওত পেতে থাকে। এ ছাড়া কম্পিউটারের দোকানগুলোয় অবস্থান নিয়ে এসব দালাল সাধারণ মানুষের সরলতার সুযোগে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। এ ছাড়া ভেরিফিকেশনে পুলিশের হয়রানির শিকার হতে হয় বলেও অনেকে জানান।
জানা গেছে, আবেদনকারীর এনআইডিতে যদি কোনোরকম ভুল থাকে, তাহলে তা সংশোধনের জন্য ১০, ২০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার- এমনকি কারও ক্ষেত্রে লাখ টাকাও হাতিয়ে নেয় দালালরা। অফিসের পাশের এসব দোকানে নিজের ও মা-বাবার এনআইডি সংশোধন, পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব কাজ মোটা দাগের চুক্তিতে সম্পন্ন করে দেওয়া হয় বলে বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে দালালদের কোনো দৌরাত্ম্য নেই। পাসপোর্ট ডেলিভারি, নতুন আবেদন গ্রহণ, ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ নেওয়াসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে যারা শিক্ষিত ও সচেতন, তারা অতি সহজেই কোনো হয়রানি ছাড়া তাদের পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যায় পড়তে হয় কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষকে। তারা নতুন পাসপোর্টের আবেদনের জন্য আশপাশের কম্পিউটারের দোকানে ভিড় জমান। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দোকানিরা তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেন।
পাসপোর্ট অফিসের দালালরা এখন ভেতরে না ঢুকতে পেরে অফিসের আশপাশের কম্পিউটার দোকানগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে বলে কালবেলার কাছে দাবি করেন সখীপুর থানার মোল্লার বাজারের বাসিন্দা রাসেল মিয়া।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুধু তা-ই নয়, তারা জেলার প্রতিটি উপজেলার বাজারে ঘুরে ঘুরে সেখানকার কিছু কম্পিউটার দোকানিকে ম্যানেজ করেছেন। এখন কম্পিউটার দোকানি ও দালালরা মিলে নতুন এক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এ সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলে গ্রাহক হয়রানি কোনো দিনও বন্ধ করা যাবে না বলে মনে করেন তিনি।
গোসাইরহাটের নাগেরপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. জাকির হোসেন বলেন, কয়েক দিন আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করিয়ে দেওয়াসহ আমার একটি পাসপোর্ট করানোর জন্য পাসপোর্ট অফিসের বাইরের একটি কম্পিউটারের দোকানের কর্মী ১৩ হাজার টাকা দাবি করে। পরে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে অন্য একজনকে দিয়ে ৭ হাজার টাকায় পাসপোর্ট করিয়েছি।
নড়িয়া এলাকার এক গৃহিণী বলেন, পাসপোর্ট করার জন্য কী কী কাগজ লাগে বা কী কী নিয়ম তা আমরা জানি না। তাই আমার হাজবেন্ড আমাকে ইতালি নেওয়ার জন্য পাসপোর্ট করাতে এক দালালের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। সব কাগজপত্র ঠিক করে পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ পাসপোর্ট করানোর জন্য ২০ হাজার টাকায় তার সঙ্গে চুক্তি করেছেন। আমার বাবাকে নিয়ে পাসপোর্ট অফিস-সংলগ্ন একটি কম্পিউটারের দোকানে তার সঙ্গে কাজ শেষ করেছি। কিন্তু পরে জানলাম পাঁচ বছরের জন্য ৪৮ পৃষ্ঠার সাধারণ পাসপোর্ট করাতে লাগে ৪ হাজার ২৫ টাকা। অথচ দালাল অতিরিক্ত টাকাগুলো নিয়ে নিল।
ভেদরগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর বাজারের দোকানি রেজাউল মুন্সি বলেন, ইতালিতে ভিসার আবেদন করব বলে পাসপোর্ট করতে যাই। গিয়ে দেখি এনআইডি ও জন্মসনদে নামে ভুল রয়েছে। ভুল সংশোধনের জন্য নির্বাচন অফিসে আবেদন করে মাসের পর মাস ঘুরেও সমাধান করতে পারিনি। পরে বাধ্য হয়ে এক দালালের সঙ্গে ৩০ হাজার টাকায় চুক্তি করলে আমি পাসপোর্ট হাতে পাই।
ডামুড্যা উপজেলার মালেয়শিয়াপ্রবাসী মাহবুব তালুকদার বলেন, আমার আগের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হলে নতুন করে ই-পাসপোর্ট করার জন্য কাগজপত্র জমা দিই। সবকিছু ঠিক থাকলেও বিপত্তি বাধে পুলিশ ভেরিফিকেশনে। ডামুড্যা থানার এএসআই আমাকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বলেন। আমি দেখা করলে তিনি নানা অজুহাত দেখান। এরপর কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে ঘোরাতে থাকেন। আমি কোনো উপায় না পেয়ে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তার সঙ্গে দফারফা করি।
সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে এ বিষয়ে মহসিন বেপারি নামে এক দালালের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ভাই, আমরা আপনাদের পাসপোর্ট করায়া দিয়ে ২ থেকে ৪ হাজার টাকা কামাই করে সংসার চালাই। তবে যাদের নিজের ও পরিবারের এনআইডি কার্ড ও জন্মনিবন্ধনে সমস্যা থাকে, তাদের কাজ করে কিছু বেশি টাকা লাভ করা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ টাকা চলে যায় সংশোধন করতে। নির্বাচন অফিসের কিছু কর্মচারী আমাদের এ কাজ করে দিয়ে বেশিরভাগ টাকা নিয়ে যায়। আমরা দালালরা তাদের কাছে জিম্মি।’
এনজিও ও মানবাধিকারকর্মী ড. মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের দালালরা একটি সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা মোটেই উচিত নয়। আবার পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে অর্থ আদায় করাও ঠিক নয়। আমরা সবাই চাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক। সরকারি অফিসে সেবা নিতে অতিরিক্ত টাকা কেন দেওয়া লাগবে? এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে প্রশাসনকে।
এ ব্যাপারে শরীয়তপুর আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপসহকারী পরিচালক নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে শরীয়তপুর পাসপোর্ট অফিসের চিত্র অনেকটাই পাল্টে গেছে। আমি এখানে দায়িত্ব পাওয়ার আগে একটু সমস্যা ছিল। সেগুলো ঠিক করেছি। বর্তমানে আমাদের সেবার মান অনেক উন্নত হয়েছে। আমার রুমে সেবাগ্রহীতারা বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারেন। তবে পুরোপুরি পরিবেশ ঠিক করা কঠিন। বাইরে ফটোকপির দোকানে কী হয়, সেটা তো বলা সম্ভব নয়। এখানে দালালদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় না।
এ সময় তিনি সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চেয়ে বলেন, আপনাদের পক্ষ থেকে কোনো পরামর্শ থাকলে দেবেন, সেগুলো আমরা ঠিক করে দেব।
গ্রাহকদের আশ্বাস দিয়ে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার মো. নজরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের আশপাশে যদি কোনো দালাল চক্রের দেখা মেলে, তাহলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনে যদি কোনো পুলিশ সদস্য টাকা নিয়ে থাকেন, আর তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পুলিশি সেবার ক্ষেত্রে কেউ হয়রানির শিকার হলে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন