বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

এক বিদ্যালয়ের ৬৬ ছাত্রই মুক্তিযোদ্ধা

ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি : কালবেলা
ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়। ছবি : কালবেলা

১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকা। পেয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্র। দেশকে বাঁচাতে জীবনবাজি রেখে যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন তাদের প্রতি সর্বদা বিনম্র শ্রদ্ধা।

সেদিন জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়ে ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সম্মুখযুদ্ধে তারা বীরের মতো লড়াই করেছেন। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র বশির আহমেদ, নূর ইসলাম ও মতিউর রহমান।

জানা যায়, জামালপুর জেলার সর্ব উত্তরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর। কামালপুরের পাশেই ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এই মহেন্দ্রগঞ্জ। কৌশলগত কারণে ধানুয়া কামালপুর ছিল পাক হানাদার বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যে কারণে কামালপুরে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। কামালপুর দখলে নিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সম্মুখযুদ্ধে পা হারান কর্নেল আবু তাহের।

শহীদ হন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ শতাধিক বীরযোদ্ধা। একসময় অবস্থা বেগতিক দেখে ৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্ত হয় ধানুয়া কামালপুর। কামালপুরে এমন বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বীর বিক্রম, বীর উত্তম ও বীর প্রতীক খেতাব পান মোট ২৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৭১ সালের সেই সময়টায় বিভিন্ন সেক্টর ও সাবসেক্টরে ভাগ করা হয় পুরো দেশকে। মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন কোম্পানিতে মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ চলছে এমন খবর চলে আসে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নাম লেখাতে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। একে একে ৬৬ জন শিক্ষার্থী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে ছুটে যান ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে। প্রশিক্ষণ নিয়েই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুবাহিনীর ওপর। দীর্ঘ ৯ মাস বীরের মতো লড়াই করে ছিনিয়ে আনেন লাল-সবুজের পতাকা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ধানুয়া কামালপুর কো-অপারেটিভ উচ্চবিদ্যালয়ে আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। দেশের পরিস্থিতি আমরা বুঝে গিয়েছি। তখন স্বাধীনতার ডাক আমাদের কাছেও পৌঁছে গেছে। গ্রামাঞ্চল হলেও নানা মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের খবর পাচ্ছিলাম। আর ওপাশেই ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ, সেখানে গিয়ে দেখতাম যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। আমাদের বয়সী অনেকেই যুদ্ধে যাচ্ছে, নিজেকে ঘরে রাখা কঠিন হয়ে গেল। চলে গেলাম মুক্তিযুদ্ধে। আমাদের স্কুলের ৬৬ জন ছাত্র মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই।

জানা যায়, ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লের বললেন, কামালপুর পাকিস্তানি ক্যাম্পে কে যাবে আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে। কামালপুর সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় গ্রাম ব্রাহ্মণপাড়ায় তখন মুক্তি বাহিনীর হাজারো সদস্য উপস্থিত। তবে কেউ সাহস করে বলতে পারছিল না কে যাবে। ব্রিগেডিয়ার ক্লের যখন প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করলেন, ঠিক তখনই মুক্তিবাহিনীর এক কিশোর যোদ্ধা বলে ওঠেন, আমি যাব চিঠি নিয়ে। সেই কিশোর যোদ্ধা সাহসী বশির আহমেদ।

বশির আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আমাদের স্কুলের ১০০ গজ দূরেই ক্যাম্পটি। আত্মসমর্পণের চিঠিটি পকেটে নিয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্পের সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আমার হাতে থাকা সাদা পতাকা নাড়ালাম। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পেলাম না। ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, শত্রুপক্ষের ছোড়া একটি গুলিই কিশোর বশির আহমেদের জীবন কেড়ে নিতে পারত। তবে কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনী একসময় ক্যাম্পের ভেতরে তাকে ডেকে নেয়। তিনি আত্মসমর্পণের চিঠি পৌঁছে দিলেন বিওপির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের হাতে। দীর্ঘক্ষণ চিঠির বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না পাক বাহিনী।

তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর চারটি যুদ্ধবিমান হামলা শুরু করল পাকিস্তানি ক্যাম্পে। বশির আহমেদকে বাংকারে ঢোকানো হলো। কয়েকজন সৈনিক হতাহত হলো। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে গেল। এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর আরও একজন এলেন আত্মসমর্পণের চিঠি হাতে। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুর রহমান। চারপাশ থেকে হামলায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। শত্রুমুক্ত হয় কামালপুর রণাঙ্গন।

বিদ্যালয়টির বর্তমান প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমি গর্বিত যে আমার এই বিদ্যালয়ের ৬৬ জন প্রাক্তন ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৬৪ সালে এই স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় আশপাশের এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। সবাই কামালপুরেই পড়তে আসতো। প্রায় ৮শ শিক্ষার্থী ছিল বলে জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ এক রণাঙ্গন ছিল বলে স্কুলের এত ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বিষয়টি আমাকে প্রতিদিনই সব কাজে উৎসাহিত করে। আমি গর্বিত এমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলে।

তিনি জানান, ১১ নম্বর সেক্টরের এই বিদ্যালয়টির আশানোরূপ উন্নয়ন হয়নি। ক্লাস রুমের সংকট রয়েছে। ইতিহাস রক্ষায় বিদ্যালয়টি আধুনিকায়নের দাবি জানান তিনি।

ধানুয়া কামালপুর ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান লাকপতি কালবেলাকে বলেন, ১৯৬৪ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭১ সালে এ বিদ্যালয় থেকে ৬৬ জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এটা অবশ্যই ইতিহাসের অংশ। এই ইউপির চেয়ারম্যান হিসেবে গর্বিত আমি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাছ চুরি করতে গিয়ে ছাত্রদলের ৭ নেতাকর্মী ধরা

বিজয় দিবস রেটিং দাবার শীর্ষে ২০ জন

হিমাগার থেকে প্রায় ২০০০ বস্তা আলু জব্দ, খোলা বাজারে বিক্রি

বিজয় দিবসে ডিএসসিসির জাদুঘর-পার্ক-মাঠ উন্মুক্ত থাকবে

মহান বিজয় দিবস উদ্‌যাপনে যেসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিল র‌্যাব

নোবিপ্রবির নতুন ট্রেজারার ড. হানিফ

প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের আহ্বান জামায়াত আমিরের

চট্টগ্রাম-১৫ আসনের সাবেক এমপি নদভী আটক

আগামীর সরকার হবে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রবিন্দু : জেএসডি

চলনবিল এখন মধুর বিল

১০

ব্লুমবার্গের ইএসজি স্কোরে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে আইডিএলসি

১১

ঝুট ব্যবসা নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ

১২

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জাতীয় নাগরিক কমিটির ৩ নেতাকে বেধড়ক মারধর

১৩

প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য

১৪

যাচাই না করেই ফেসবুকে ছবি পোস্ট তসলিমা নাসরিনের, সমালোচনার ঝড়

১৫

বিএনপি নেতা বকুলের সুস্থতা কামনায় এতিমদের খাবার বিতরণ

১৬

চক্রান্তকারীদের নীলনকশা আজও বিদ্যমান : তারেক রহমান

১৭

সৎ ছেলেদের নির্যাতনে হাসপাতালে মা হোসনেয়ারা

১৮

‘লীগ’ দেখেই ক্ষেপলেন তারা

১৯

মারিয়াম ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মিরপুরে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প

২০
X