রাজবাড়ী পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতেই দেখা যায় একজন আনসার সদস্য গেটে বসে আছেন। গেট পার হওয়ার পর অফিসের ভবনের ছবি তুলতে গেলেই বাধে বিপত্তি। গেটে বসে থাকা মো. মমিনুল নামের সেই আনসার সদস্য উঠে এসে বলছেন, এখানে কোনো ক্যামেরা ওপেন করা যাবে না এবং পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে মোবাইল বের করে কোনো ছবি তোলা যাবে না। এখানে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ।
এরপর নিচতলায় গিয়ে বিভিন্ন কক্ষে ঢুকতেই মোবাইল হাতে দেখে কর্মরতরা বলে উঠলেন, ‘এখানে এসেছেন যে স্যারের অনুমতি নিয়েছেন? এখানে স্যারের অনুমতি ছাড়া মোবাইল বের করতে পারবেন না এবং কোনো প্রকার ছবি তুলতে পারবেন না।’
চারদিকে তাকালে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের বাইরে-ভেতরে দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন নির্দেশনা টাঙানো আছে। তবে এটা শুধু নামমাত্র টাঙানো আছে। মূলত কোনো নির্দেশনাই মানা হচ্ছে না।
যেমন নির্দেশনায় লেখা আছে: ‘আবেদনকারী ছাড়া পাসপোর্ট অফিসের মধ্যে কেউ ঢুকতে পারবেন না’। অথচ প্রতিনিয়ত আবেদনকারীর সঙ্গে দালাল ও কম্পিউটার অফিসের লোকজন ঢুকছে আর বের হচ্ছে। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য থাকার কারণে দালালরা সহজেই পাসপোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছে। অথচ যারা দালাল ছাড়া আবেদন করছে, তাদের পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। এমন চিত্র রাজবাড়ী পাসপোর্ট অফিসের নিত্য ঘটনা। এখানে সরেজমিনে সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বললে তারা এসব অভিযোগ জানান।
অভিযোগ রয়েছে, রাজবাড়ী পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন সংশোধনীর ক্ষেত্রে। দালাল ছাড়া পাসপোর্টের আবেদন জমা দিলেই বিভিন্ন ধরনের ভুল ধরা হয়। কিন্তু দালালের মাধ্যমে করলেই সহজে পাওয়া যাচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পাসপোর্ট অফিসের পাশেই রয়েছে অসংখ্য কম্পিউটারের দোকান। এসব দোকানের মূলত প্রধান কাজই হচ্ছে পাসপোর্টের আবেদন করে দেয় এবং সাধারণ গ্রাহকদের ভয় দেখানো হয় যে, ভেতরে গেলে সহজে পাওয়া যাবে না, ভেরিফিকেশনে ঝামেলা হবে। কিন্তু তাদের কাছে করলে কোনো হয়রানি ছাড়া পাসপোর্ট পাওয়া যাবে। এ বলে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীরা জানান, পাসপোর্ট করতে সরকারি ফি নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু এর বাইরে দালাল ও অফিসে কর্মরতদের যোগসাজশে সাধারণ গ্রাহকদের কাছ থেকে ২৫০০-৩০০০ টাকা বাড়তি নিয়ে থাকে। এই অতিরিক্ত টাকা যারা দেয়, তারা দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পান। আর যারা নিজে নিজে করতে যান, তাদের নানা ধরনের ভুল ধরে হয়রানি করা হয়।
তারা আরও বলেন, পাসপোর্ট অফিসের পাশেই রয়েছে অসংখ্য কম্পিউটারের দোকান। এসব দোকানের মূলত প্রধান কাজই হচ্ছে পাসপোর্টের আবেদন করে দেয় এবং সাধারণ গ্রাহকদের ভয় দেখানো হয় যে, ভেতরে গেলে সহজে পাওয়া যাবে না, ভেরিফিকেশনে ঝামেলা হবে। কিন্তু তাদের কাছে করলে কোনো হয়রানি ছাড়া পাসপোর্ট পাওয়া যাবে। এ বলে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজবাড়ী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান খান কালবেলাকে বলেন, আমি আসার এক আত্মীয়ের পাসপোর্টের জন্য আজসহ (গতকাল) চারবার এসেছি। আমি নিজেও পাসপোর্টের আবেদন করেছি। আবেদন জমা দেওয়ার পর দায়িত্বরত কর্মকর্তা আমাকে বলেন, সংশোধন করে আসতে হবে। সংশোধন করে এলে বিরক্ত হয়ে আবার বলে ‘আপনি বারবার ভুল করেই নিয়ে আসেন কেন?’ এমনটা সবার সঙ্গে করে। আমরা চাই পাসপোর্ট অফিসের পাশে কোনো কম্পিউটার দোকান রাখা উচিত নয় এবং অফিসের গেটে আবেদনকারী ছাড়া আর কেউ ঢুকবে না, এর একটা ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
নাজমা বেগম নামের এক নারী কালবেলাকে বলেন, আমি গত মার্চে পাসপোর্টের আবেদন করেছি। এখনো পাসপোর্ট হাতে পাইনি। আমার প্রায় ২৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। আমার বাবার নামের জায়গায় স্বামীর নাম দেওয়া হয়েছে। এগুলো তারা ইচ্ছা করে ভুল করেছে। সংশোধনের নামে বাড়তি টাকা নেওয়া হয়েছে আমাদের কাছ থেকে। এ ভোগান্তির শেষ কোথায়।
অফিসের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতিদিন পাসপোর্টের জন্য ১০০ জনের মতো গ্রাহক পাসপোর্টের আবেদন করেন। গত ৫ আগস্টের পর থেকে সনাতনী ধর্মের মানুষ বেশি আবেদন করেছেন এবং ভারতের মেদেনীপুর ওরসে যাওয়ার জন্য অনেক মুসলিম পাসপোর্টের আবেদন করেছেন। তবে আগের চেয়ে প্রতিদিন পাসপোর্ট বিতরণ বেশি হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, পাসপোর্ট অফিসে মোট জনবল থাকার কথা রয়েছে আটজন; কিন্তু জনবল আছে পাঁচজন। এ সংকটের কারণে আবেদনপত্র সময়মতো প্রস্তুত করা সম্ভব হয় না। এ কারণে গ্রাহকরাও দ্রুত পাওয়ার আশায় বিভিন্নজনের মাধ্যমে আবেদন করেন এবং বেশি টাকা দেন। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ বেশি টাকা নিলেও কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে দেয় বলেও জানা গেছে।
এক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, পাসপোর্ট অফিসের জনবল সংকট রয়েছে। আর এ কারণেই আমরা এখান থেকে গ্রাহকদের আবেদন করাতে পারছি না। গ্রাহকরা কম্পিউটারের দোকান থেকে আবেদন করছে। এ কারণে যদি কোনো কম্পিউটারের দোকানি অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে থাকে, তাহলে আমাদের কী করার আছে? এ বিষয়ে তো আমাদের কেউ কিছু বলে না। তবে অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
জানতে চাইলে রাজবাড়ী পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আবজাউল আলম কালবেলাকে বলেন, দালালের বিষয়টা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। তবে আমার অফিসে সেবাপ্রত্যাশী মানুষ কোনো সমস্যায় পড়েছে কি না, সেটা দেখা হয়। আমার অফিসে শতভাগ দালালমুক্ত।
নিজে নিজে আবেদন করলে ভুলের শেষ নেই আর দালাল ধরলেই দ্রুত পাসপোর্ট মেলে কীভাবে, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বাইরে মানুষ যখন আবেদন করতে যায়, তখনই তারা একটা খপ্পরে পড়ে। তারা আমাদের নাম ভাঙিয়ে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকে। যখন এসব অভিযোগ আমাদের কাছে আসে, আমরা চেষ্টা করি প্রশাসনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে। তাদের বিভিন্নভাবে আমরা প্রতিহত করার চেষ্টা করি। ভবিষ্যতে এসব অনিয়ম বন্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
মন্তব্য করুন