রান্না শেষে শীতের এই সময়ে চুলার দুই পাশে দুই পা দিয়ে একটু উষ্ণতা নিচ্ছিলেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার জাহানারা বেগম (৫৬)। একটু অসতর্ক হতেই তার শাড়ির নিচের অংশে আগুন ধরে যায়। গত ৫ ডিসেম্বর এই ঘটনায় তার কোমর থেকে নিচের অংশ পুড়ে গেছে।
পরে তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন এ গৃহিণী। তবে পায়ুপথসহ শরীরের ১৮ শতাংশ দগ্ধ হওয়ায় তীব্র যন্ত্রণায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন তিনি।
জাহানারা বেগমের পাশের বেডেই চিকিৎসাধীন আছে আইরিন আক্তার নামে ৯ বছর বয়সী এক শিশু। রান্না করা গরম ডালের মধ্যে পড়ে তার মুখ, গলা, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে।
জানতে চাইলে শিশুটির মা বলেন, মেয়েকে ঘরে পড়াশোনায় রেখে আমি রান্না করছিলাম। কিন্তু মেয়ে হঠাৎ দৌড়ে রান্না ঘরে ঢুকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গরম ডালের মধ্যে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দগ্ধ, ডায়াবেটিক ফুড আলসার, ক্যানসার ও সড়ক দুর্ঘটনার রোগীও রামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে দিনদিন বাড়ছে বলে জানান চিকিৎসকরা। এতে প্রাণহানিসহ অঙ্গহানীর ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দগ্ধ হয়ে ভর্তি হওয়া মো. খলিল (৫০) নামে এক ব্যক্তির দুই হাতের কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত অপারেশন করে কেটে ফেলা হয়েছে। নওগাঁ সদর উপজেলার এই বাসিন্দা পেশায় রাজমিস্ত্রী।
মো. খলিল বলেন, একটি ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের কাজ করার সময় রাস্তার পোলের তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে আমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় গত ২৫ নভেম্বর রামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তাৎক্ষণিক অপরেশন করে দুই হাতের কনুইয়ের নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। এ ছাড়া বুক-পিঠসহ শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় এখনো এখানেই চিকিৎধীন রয়েছেন তিনি।
রামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নেন দগ্ধ রোগীরা। সারা বছরই রোগী থাকার পাশাপাশি ক্রমেই বাড়ছে সংখ্যা। গত বছর এখানে এক হাজার ১৮০ জন চিকিৎসা নিলেও চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১০ মাসেই এক হাজার ২২২ জন রোগী ভর্তি হন। এদের মধ্যে আগুনে পোড়া রোগী ৫৩৩ ও তরল বার্ন রোগী ৫১৯ জন। তাদের মধ্যে শিশু ছিল ৩১৭ জন। শীতে সেই সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধির শঙ্কা করা হচ্ছে।
নিবন্ধন খাতার তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে মাত্র ১০ দিনে (১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) রামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৬১ দগ্ধ রোগী। এর মধ্যে ৯ জন প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ফিরে গেলেও বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ৫২ জন। তাদের মধ্যে ৩৫ই শিশু। শিশুর সংখ্যা মোট রোগীর ৫০ শতাংশের বেশি। এই শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে কিংবা গরম তরল ও পানিতে পুড়ে দগ্ধ হচ্ছেন তারা।
জানা যায়, রংপুর ও বগুড়া ছাড়া উত্তরবঙ্গের প্রায় সব জেলার দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা হয় রামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এই ইউনিটটিতে বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও নেই আইসিইউ সাপোর্ট। ফলে আইসিইউর প্রয়োজন না হলে সব ধরনের রোগীর এই ইউনিটেই চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, পোড়া কোনো রোগ নয়, এটি দুর্ঘটনা। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন। দগ্ধের ধরন ও মাত্রাভেদে টানা দুই বছরও চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। টিমওয়ার্কভিত্তিক চিকিৎসা লাগে। অথচ প্রকৃতিতে শীত মৌসুম শুরুর পর বিভিন্নভাবে অগ্নিদুর্ঘটনা ও পোড়া রোগী বাড়ছে। একটু উষ্ণতার জন্য শীত তাড়াতে আগুনের অসতর্কতামূলক ব্যবহারে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।
হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান ডা. আফরোজা নাজনীন বলেন, প্রথমত দেশের মানুষ স্ক্যাল্ড বার্ন তথা গরম পানি, গরম দুধ, গরম তরকারি বা গরম কোনো তরল পদার্থ দ্বারা পোড়ে বেশি। দ্বিতীয়ত, ইলেকট্রিক বার্ন অর্থাৎ বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হন। তৃতীয়ত, ফ্লেম বার্ন তথা সরাসরি আগুনের সংস্পর্শে পুড়ে থাকে যেমন মোমবাতি, কোরোসিন বাতি, চুলা বা অন্যভাবে শাড়ি, ওড়না, জামা-পাজামা বা পরিধেয় বস্ত্রে আগুন লাগা। বাকি রোগীগুলো সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভর্তি হন।
তিনি বলেন, ‘আগে শুধু শীতকালে রোগী বেশি আসলেও এখন ইলেকট্রিক ও তরল বার্নের কারণে সারা বছরই রোগী থাকছে। তরল বার্নে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। সচেতনতার অভাবেই এটি বাড়ছে। ফলে অনেক সময় অনেকের হাত বা পা কেটে ফেলতে হচ্ছে। আবার, অনেককে বাঁচানোও সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসা শেষে অনেকেই হাত, পা বা চেহারার বিকলাঙ্গতা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। পোড়া বা পোড়াজনিত বিকলাংগতা থেকে বাঁচতে হলে জনসচেতনতা খুবই জরুরি।’
মন্তব্য করুন