রাজহাঁসের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব। প্রতিদিন হয় কথোপকথন। গতিময় জীবনে যখন মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে তখন এমন গল্পে বিশ্বাস রাখা বড্ড কঠিন। আর আবেগের সঙ্গে সম্পর্কটা যখন এক রাজহাঁসের তখন আষাঢ়ে গল্পের তমকা দিতেই ভুলবেন না অনেকেই। তবে রব্বানীর সঙ্গে যে বোদের (হাঁসের নাম) ভাবের আদান-প্রদান হয় অচেনা কোনো এক ভাষায় তার প্রমাণ মিলল বগুড়ার সাবগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে এসে।
প্রায় চার বছর ধরে এই রাজহাঁসের সঙ্গে অসাধারণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে বগুড়া পৌর এলাকার কুরশা মহল্লার পিকআপচালক গোলাম রব্বানীর। ৩ ছেলে ও ১ কন্যার জনক রব্বানী। অভাবের সংসার। নিজেরা যা খায় হাঁসটিও তাই খায়। ওর জন্য বাড়ির কোনো খরচ নেই।
২০২০ সালে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল থেকে একজোড়া রাজহাঁস কিনে আনেন তিনি। পরে বাড়িতে এনে একটি হাঁস মারা যায়। তখন একা হয়ে পড়ে অন্য হাঁসটি। তারপর থেকেই বন্ধুত্ব শুরু। রাজহাঁসের সঙ্গে বন্ধুত্ব-ভালোবাসার সম্পর্ক গত চার বছর ধরে। রাজহাঁসটি গোলাম রব্বানীর সঙ্গে অনেকটা একাত্মা হয়ে গেছে। গোলাম রব্বানী যেখানে যান, হাঁসটিও পিছু পিছু ছুটে চলেন সেখানে। পাকা সড়ক ধরে কখনোবা যানজট এড়িয়ে। হাট-বাজার, চা স্টল, দোকানপাট সবত্রই রব্বানীর সঙ্গে চলাফেরা করে রাজহাঁসটি। তবে পথে-ঘাটে কেউ কিছু খেতে দিলে খায় না সে। তবে রব্বানী তাকে পানি খেতে দিলে শুধু পানি খায়।
শুধু তাই নয়, বাড়িতে একা থাকতে না চাইলে রব্বানী তাকে পিকআপ ভাড়া নিয়ে রংপুর রাজশাহী, পঞ্চগড় জামালপুর জেলায় সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। এখনো আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গেলে তাকে কোলে করে সঙ্গে নিয়ে যান। রাজহাঁস এবং মানুষের মধ্যে এমন ভালোবাসা দেখে অভিভূত স্থানীয় লোকজন। তারা বলছেন, এটি বিরল ঘটনা।
বর্তমানে গোলাম রব্বানীর বাড়িতে পুচকি নামে আরও একটি নারী হাঁস আছে। দুজন মিলে বাড়িতে থাকলেও মূলত বোদের সঙ্গে মিতালি তার।
গোলাম রব্বানী বলেন, ‘প্রায় চার বছর আগে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলা থেকে একজোড়া রাজহাঁস কিনেছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে নারী হাঁসটি মারা যায়। পরে সঙ্গীহীন হয়ে পড়া পুরুষ হাঁসটি শুধু ডাকাডাকি করত। এক সময় হাঁসটির সঙ্গে আমার ভাব জমে যায়।’
তিনি জানান, হাঁসটি সব সময় তার সঙ্গে থাকতে চায়। তিনি যেখানে যান, হাঁসটিও সেখানে যেতে চায়। বাড়ির বাইরে থেকে ফিরে আসার পর তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলে হাঁসটি দরজার কাছে চলে যায়।
এছাড়া, তাকে দীর্ঘক্ষণ না দেখতে পেলে হাঁসটি ডাকাডাকি করতে থাকে। তখন মুঠোফোনে হাঁসটিকে গোলাম রব্বানীর কথা শোনাতে হয়। ওই পাশ থেকে তিনি হাঁসটিকে থামতে বললে সেটি শান্ত হয়ে যায়।
গোলাম রব্বানী দাবি করেন, তিনি হাঁসটির ভাষা বুঝতে পারেন এবং হাঁসটিও তারা ভাষা বুঝে। আর এই কারণে তিনি হাঁসটির নাম রেখেছেন ‘বোদ’। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, হাঁসটি সব সময় আমার সঙ্গে থাকতে চায়। পিকআপ নিয়ে যখন দূরে কোথাও যাই, হাঁসটিও সেখানে যেতে চায়। পরে যখন বুঝিয়ে বলি, না তোমার যাওয়া হবে না, তুমি থাকো, আমি ট্রিপ দিয়ে ফিরে আসব। তখন ও শান্ত হয়ে যায়। তবে তার ধারণা হাঁসটির মধ্যে অলৌকিক কিছু আছে। এদিকে, গোলাম রব্বানীর সঙ্গে রাজহাঁসের এমন ভালোবাসার সম্পর্ক দেখে অভিভূত স্থানীয় লোকজন। তারা বিষয়টি আশ্চর্যজনক বলে মনে করছেন। এর আগে, এমন ঘটনা কখনো দেখেননি বলে জানান।
বগুড়া পৌরসভার ১৯নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের গভীর ভালোবাসা মাঝেমধ্যে দেখতে পাওয়া গেলেও রাজহাঁসের সঙ্গে এমন সম্পর্ক বিরল। চার বছর ধরে দেখছি, হাঁসটি তার মালিকের সঙ্গে সাবগ্রামের হাট-বাজারে সর্বত্র ঘোরাফেরা করে। মালিক যেখানে যায়, হাঁসটিও সেখানে যায়। বিষয়টি আমরাও উপভোগ করি।’
সাবগ্রাম বাজারের চা বিক্রেতা ফারুক হোসেন বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রাণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারি না। অথচ রব্বানীর পোষ মেনেছে হাঁসটি। এদিকে, গোলাম রব্বানীর সঙ্গে রাজহাঁসের এমন ভালোবাসার সম্পর্ক দেখে অভিভূ‚ত স্থানীয় লোকজন। তারা বিষয়টি আশ্চর্যজনক বলে মনে করছেন। এর আগে এমন ঘটনা কখনো দেখেননি বলে জানান।
গোলাম রব্বানীর স্ত্রী ছোবেদা খাতুন বলেন, আমরা পরিবারের সবাই রাজহাঁসটিকে খাবার দেই। কিন্তু সেটি আমাদের কাছে আসে না। আমার স্বামী যেখানে যায় রাজহাঁসও পেছনে পেছনে চলে যায়। এতে সাংসারিক কাজের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। তারপরও হাঁসটির এমন ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ।
মন্তব্য করুন