ক্ষুধা শব্দটির সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম। তবে সংজ্ঞা যাই হোক না কেন; পেটের ক্ষুধাই সবচেয়ে বড় ক্ষুধা। আর পেটের এই ক্ষুধা নিবারণে মানুষ কত কিছুই না করে। এমনই একজন অসহায় ক্ষুধার্ত আয়মনা বেওয়া। পেটের দায়ে তিনি ঘুরে বেড়ান ইঁদুরের গর্তে গর্তে।
হেমন্তের এ সময়ে কৃষক-কৃষানিরা যখন আমন ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তখন সকাল-সন্ধ্যা ইঁদুরের গর্ত খুঁজছেন রাজশাহীর দুর্গাপুর পৌর এলাকার শালঘরিয়া গ্রামের বাসিন্দা এই বিধবা। গর্ত খুঁজে পেলেই শুরু করছেন খোঁড়াখুঁড়ি, বের করছেন ইঁদুরের জমানো ধানের শীষ। এ ধান বিক্রির টাকা দিয়েই বছরের অর্ধেকটা সময় সংসার চলে ৫৮ বছর বয়সী হতদরিদ্র এই নারীর।
নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে আয়মনা বেওয়া বলেন, অনেক আগেই স্বামী হারিয়েছি। একমাত্র ছেলে থেকেও নেই। স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতায় খোঁজ নেয় না ছেলে। তাই বৃদ্ধ বয়সেও নিজেকেই জীবিকার সন্ধান করতে হয়। ফলে প্রতিদিন সকালে মানুষের বাড়িতে কাজে যাই। আর আমন ধানের মৌসুম এলে বাসাবাড়ির কাজের ফাঁকে সকাল-বিকেল মাঠে গিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁজি। সেই গর্ত থেকে কুড়ানো ধানে আমার বছরের অর্ধেকটা সময় পার হয়ে যায়। এ ছাড়াও এ ধান দিয়েই শীতের পিঠাও খাওয়া হয়। আর বছরের বাকি অর্ধেক দিনমজুরের কাজ করেই চলে একার সংসার।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে জানা যায়, প্রতি বছর দেশে ইঁদুরের কারণে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়। আবার, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এশিয়ায় ইঁদুর বছরে যে পরিমাণ ধান-চাল খেয়ে নষ্ট করে, তা ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবারের সমান। শুধু বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০ থেকে ৫৪ লাখ মানুষের এক বছরের খাবার নষ্ট করে। এদিকে, ইঁদুরের জ্বালায় প্রতি বছর অতিষ্ঠ থাকেন বলে জানান কৃষকরা।
দুর্গাপুর পৌর এলাকার শালঘরিয়া গ্রামের কৃষক শামীম হোসেন বলেন, আমন মৌসুমে কৃষকরা ধান কেটে রোদে শুকিয়ে ঘরে তোলার আগেই ইঁদুর পাকা শিষ কেটে গর্তে নিয়ে রাখে। ইঁদুরের রাখা ধানের সেই শীষ খুঁজে বের করেন আয়মনা বেওয়াসহ আরও অনেকে। এ ধান বিক্রি করেই অর্ধেক বছর পার হয় তাদের। এটাই হচ্ছে তাদের নবান্ন উৎসব। তাই তাদের ধান সংগ্রহে আমরা বাধা দিই না।
জানা যায়, রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় প্রতি বছরই আমন মৌসুমে ধান কাটার পর ক্ষেতগুলোতে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে শীষ সংগ্রহ করেন আয়মনা বেওয়া। জীবিকার অন্বেষণে প্রতি পদে নানা ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয় তাকে।
ইঁদুরের গর্তে সাপ পোকা-মাকড়ের ভয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আয়মনা বেওয়া বলেন, পেটের খিদের চেয়ে ভয় আর কিছুতে নেই। তাই গর্ত থেকে ধান সংগ্রহের সময় এগুলো মাথায় থাকে না। কেননা, শুধু বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চলে না। তাই খুন্তি কোদাল, চালন, বস্তা নিয়ে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করি। সেই ধান বিক্রির টাকা দিয়ে চলে বছরের প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস।
এ বিষয়ে দুর্গাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানা পারভীন লাবণী বলেন, ইঁদুরের গর্তে সাপ ও বিষাক্ত পোকামাকড় থাকতে পারে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এভাবে ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও অনেকে পেটের তাগিদে এ কাজ করে থাকেন। আর এতে যে কারও জীবন মৃত্যুর মুখেও পড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, কৃষকদের ক্ষতি থেকে বাঁচতে ইঁদুর নিধনের ফাঁদ এবং রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন করা সম্ভব। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন।
মন্তব্য করুন