ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মিষ্টান্ন ‘ছানার পায়েস’।
বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মুনির হোসেনের স্বাক্ষর করা এক নিবন্ধন সনদে ছানার পায়েসকে ৪৩তম জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এর আগে গত বছর জেলা ব্র্যান্ডিং বাস্তবায়ন কমিটির বৈঠকে ছানার পায়েসকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের সুপারিশ করা হয়। এ নিয়ে শেরপুর জেলার স্থানীয় সুগন্ধি চাল তুলশী মালাসহ দুটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল।
শেরপুরে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই ছানার পায়েসের এতই সুখ্যাতি যে, কোনো বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজা, অতিথি আপ্যায়নে ছানা পায়েস ছাড়া চলেই না। এক সময় হাতে গোনা দু-একটি দোকানে এই মিষ্টি তৈরি হলেও বর্তমানে জেলার অন্তত ৫০টি দোকানে ছানার পায়েস তৈরি হচ্ছে। এসব দোকানে প্রতিদিন গড়ে বিক্রি হয় প্রায় ২০০-৪০০ কেজি ছানার পায়েস। বর্তমানে প্রতি কেজি ছানার পায়েস ৩৮০-৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জন্মদিন, ঈদ, বিয়েসহ বিভিন্ন পার্টিতে ছানার পায়েসের প্রচুর অর্ডার আসে জেলার বাইরে থেকে।
জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, নকলা ও নালিতাবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে ছানার পায়েস বিক্রি হলেও মূলত শেরপুর জেলা শহরের চারু সুইটস, অনুরাধা, নিউ প্রেমানন্দ, প্রেমানন্দ গ্র্যান্ড সন্স, হোটেল আবির নিবির, হোটেল হৃদয়, দুর্গাচরণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, অমৃত গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, নন্দ গোপাল, মা ভবতারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, হোটেল নূর রহমান ও বল্লব মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ছানার পায়েস বেশি পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, ব্রিটিশ আমলে জেলার ঘোষপট্টিতে প্রথম ছানার পায়েস তৈরি হয়। সে সময়ে জমিদাররা ঘোষপট্টিতে বানানো ছানার পায়েস বিশেষ পদ্ধতিতে কলকাতায় নিয়ে যেতেন। এছাড়া আত্মীয়-স্বজন কিংবা অন্য জমিদারের কাছে উপঢৌকন হিসেবেও এ পায়েস পাঠাতেন তারা।
ছানার পায়েস তৈরির প্রধান উপকরণ হলো- দুধ, চিনি, ময়দা ও এলাচ। প্রথমে উচ্চমাত্রার তাপে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর করা হয়। এরপর আলাদাভাবে দুধ থেকে ছানা কেটে তাতে সামান্য ময়দা মিশিয়ে ছোট ছোট গুটি করা হয়। এই গুটি চিনিমিশ্রিত শিরায় ভিজিয়ে আগে তৈরি করা ক্ষীরে ছেড়ে হালকা আঁচে জ্বাল দেওয়া হয়। এভাবেই তৈরি হয় সুস্বাদু ছানার পায়েস। এক কেজি ছানার পায়েস তৈরির জন্য দুই কেজি দুধ, আধা কেজি চিনি, সামান্য পরিমাণ ময়দা ও ১০-১৫ গ্রাম এলাচের প্রয়োজন হয় বলে জানান কারিগররা।
অনুরাধা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কর্মরত কালিপদ ঘোষ নামের এক কারিগর বলেন, আমি দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে মিষ্টি তৈরির কাজ করছি। আমাদের এখানে খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি করা হয় ছানার পায়েস। তাই স্বাদটা একটু ভিন্ন, চাহিদাও ব্যাপক।
অনুরাধা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক বাপ্পি দে জানান, শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী ছানার পায়েসের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছে। জেলার বাইরে থেকে কোনো ভ্রমণপিপাসু শেরপুরে এলে, ফেরার সময় ছানার পায়েস সঙ্গে করে নিয়ে যান। ছানার পায়েস জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায়, এর কদর আরও বাড়বে বলে আমাদের বিশ্বাস। এটি আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক। আমরাও আমাদের ঐতিহ্যের সম্মান রক্ষার্থে তৈরিতে কোনো অলসতা করি না।
এ ব্যাপারে শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, শেরপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে ছানার পায়েসের বেশ সুনাম রয়েছে। দেশে-বিদেশে এ মিষ্টির বেশ কদর রয়েছে। ছানার পায়েস তৈরি ও বিপণনের সঙ্গে অনেকেই জড়িত। এটিকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের ফলে এর কদর আরও বাড়বে। এছাড়াও দেশের বাইরেও রপ্তানি করা এখন সহজ হবে।
মন্তব্য করুন