‘আগের বছর ৪০ শতক জমিত আলু নাগাছনু। টাকা আবানে তাক খেতোতে ২৫ টাকা কেজি দরে বেচাছু। এবারও আলু নাগানু হয়, বীজের যে দাম হাতে দেওয়া যাওছে না। চড়া দাম ও বীজ সংকটে এ বছর আলু চাষ করা নিয়ে সংশয় জানাচ্ছিলেন রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার দোলাপাড়া গ্রামের কৃষক আনছার আলী।’
একই এলাকার আরেক কৃষক সামছুল হকের দাবি, আলু বীজের এত চড়া দাম আগে দেখেননি তিনি। দাম বেশি হলেও বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। বীজ সংকটে তিনি এবার আলু চাষ করছেন না।
রংপুরে গত মৌসুমে আলুর চাহিদা ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার টন। সেখানে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ৪২ হাজার টন। সেই হিসাবে চাহিদার চেয়ে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৪ গুণ বেশি। অথচ এ মৌসুমে আলু চাষ করতে গিয়ে বীজ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষক। চাহিদার তুলনায় ১৪ গুণ বেশি উৎপাদন হলেও মূলত কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আলু বীজের বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে বলে অভিযোগ কৃষকদের।
কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, গত মৌসুমে রংপুর জেলায় ৫৩ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার টন। চাহিদা ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার টন। কৃষি বিভাগ বলছে, গত মৌসুমে দাম বেশি পাওয়ায় এবার আলু চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা।
লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে এ মৌসুমে চাষের জমি বেড়েছে ২০ হেক্টর। শেষ পর্যন্ত আরও বাড়তে পারে। চলতি বছর ৫৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বীজের প্রয়োজন প্রায় ৮৬ হাজার টন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হিমাগারগুলোতে লাখ লাখ বস্তা আলু কিনে রেখেছেন বিভিন্ন কোম্পানি, বড় ব্যবসায়ী ও বীজ ডিলাররা। তারা সিন্ডিকেট করে একদিকে যেমন খাওয়ার আলুর দাম বাড়িয়েছে, অন্যদিকে আলুর বীজের সংকটও তৈরি করেছে। এমনকি খাবার আলু হিসেবে সংরক্ষণ করলে বীজ হিসেবে বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
বিএডিসি কেজিপ্রতি বীজ আলু ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা এবং বেসরকারি কোম্পানিগুলো ৭০ থেকে ৮০ টাকা দর নির্ধারণ করলেও ডিলারদের কাছ থেকে কৃষকদের কিনতে হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়।
রংপুর সদরের ফতেপুর এলাকার কৃষক আমির আলী বলেন, যে আলুর বীজ গত বছর ৫০ থেকে ৬০ টাকায় কিনছি এ বছর সেই বীজের দাম ১১০ থেকে ১২০ টাকা। বাধ্য হয়ে বেশি টাকা দিয়ে বীজ কিনে চাষ করা লাগছে। এবার খরচও বেশি হবে।
বদরগঞ্জের লোহানীপাড়ার কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, যারা আলু কিনে কোল্ডস্টোরেজে রাখছে ওরাই আলুর বীজের সংকট তৈরি করেছে। অনেক চাষি আলু উৎপাদন করলেও চাষের সময় বীজ কেনে। এ সুযোগে এ বছর তারা বীজের দাম বাড়িয়েছে।
বেশি দামে আলু বিক্রির অভিযোগে বিভিন্ন হিমাগারে অভিযান শুরু করেছে ভোক্তা অধিকার ও কৃষি বিভাগ। এ সময় বেশি দামে এ বীজ বিক্রির দায়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করাও হয়।
রংপুর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন বলেন, বেশকিছু প্রতিষ্ঠান রসিদ, ভাউচার বা চালান ছাড়া বেশি দামে আলু ও আলু বীজ বিক্রি করছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে বীজ আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। প্রতি বছর আলুর উৎপাদন বাড়লেও রংপুর কৃষি অঞ্চলে আলু বীজের বরাদ্দ কমাচ্ছে সরকারি বীজ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও গত ছয় বছরে আলু বীজের বরাদ্দ কমেছে প্রায় ১ হাজার ৪২৮ দশমিক ৭৫৯ টন।
এ বছর রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ২ হাজার ২৬১ দশমিক ৬০০ টন বীজ ৮১৮ জন নিবন্ধিত ডিলারের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় বিতরণ করা হচ্ছে ৬৭৭ দশমিক ৬০০ টন। শর্তানুযায়ী আগে এলে আগে পাবেন ভিত্তিতে আগাম আলু বীজ প্রত্যেক ডিলারের জন্য বরাদ্দ এক টন। এ ছাড়া রংপুরের প্রত্যেক ডিলারের বরাদ্দ দুই ধাপে যথাক্রমে ১ দশমিক ৬৮০ ও ১ দশমিক ৪০০ টন।
বিএডিসি থেকে কৃষকদের ১১ জাতের আলু বীজ দেওয়া হচ্ছে। সেগুলো হলো বিএডিসি আলু-১ (সানসাইন), বিএডিসি আলু-৩ (সান্তানা), বারি আলু-১৩ (গ্র্যানুলা), বারি আলু-২৯ (কারেজ), বারি আলু-৮৫ (৭ ফোর ৭), বারি আলু-২৫ (এস্টারিক্স), বারি আলু-৯০ (অ্যালুইটি), বিএডিসি আলু-২ (প্রাডা), বিএডিসি আলু-৮ (ল্যাবেলা), বিয়ান্না ও কিং রাসেট।
বিএডিসির (বীজ বিপণন) রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. মাসুদ সুলতান বলেন, রংপুর অঞ্চলের ১ হাজারেরও বেশি কৃষককে আমরা ২০০ কেজি করে বীজ দিচ্ছি। আমরা আলু বীজের চাহিদার খুব অল্পই সরবরাহ করতে পারি। বরাদ্দ নির্ধারণ করা ঢাকায়। আমরা শুধু তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছি। চলতি বছর ডিলার, কৃষকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএডিসির আলু বীজের ভালো চাহিদা রয়েছে।
বরাদ্দ কম হওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, বেশকিছু বিষয় পর্যালোচনা করে বীজ বরাদ্দ হয়। এর মধ্যে গত বছরের বীজ বিক্রির গতিধারা আমলে নেওয়া হয়। গতবার বীজের দাম বেশি ছিল বলে জানিয়েছিলেন ডিলাররা।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, বীজ সংকট তৈরি হয় মূলত দুই কারণে। এই এলাকায় খাবার আলু উৎপাদন করা হলেও চাষিরা বীজ আলু উৎপাদন করে না। এ ছাড়া বীজ সংরক্ষণে বিশেষায়িত কোনো হিমাগার না থাকায় আলুর বীজ সংরক্ষণ করা যায় না। এজন্য কৃষকদের বীজ আলু উৎপাদনের জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে বীজ সংরক্ষণে বিশেষায়িত হিমাগার নির্মাণ করা হলে এ সংকট থাকবে না বলেও জানান তিনি।
কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ বলেন, এ বছর আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনা করে আগাম বীজ সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। বাজার মনিটরিং না থাকায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির ভেজাল ও মানহীন বীজে বাজার ছেয়ে গেছে। কৃষকদের জিম্মি করে অসৎ ব্যবসায়ী এবং সিন্ডিকেট মুনাফা লুটছে। উৎপাদন বিপর্যয় ঠেকাতে ভর্তুকি মূল্যে কৃষকদের মাঝে ব্যাপকভাবে বিডিএসির বীজ সরবরাহ করা উচিত।
এ বছর রংপুরে ৫৩ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উৎপাদন হতে পারে ১৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৯৩ মেট্রিক টন আলু। তবে কৃষকরা যেভাবে আলু চাষে আগ্রহী হয়েছে তাতে উৎপাদন আরও বাড়বে বলে আশা কৃষি বিভাগের।
মন্তব্য করুন