টাঙ্গাইলে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট আবেদনকারীর গোপন ওআইডি নম্বর ছাড়া মেলে না পাসপোর্ট সেবা। অন্যদিকে গোপন নম্বর পেতে গ্রাহকদের গুনতে হয় প্রায় ২৫০০ টাকা। এতে সহজেই নম্বরধারী গ্রাহকরা পাসপোর্টের সেবা পাচ্ছেন। এদিকে সাধারণ মানুষ গোপন নম্বর ছাড়া চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। তারা দ্রুতই এ ভোগান্তির পরিত্রাণ চায়। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
স্থানীয় জুয়েল বলেন, পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন ব্যক্তি আছে তাদের মাধ্যমেই পাসপোর্টের আবেদন ফাইলের ভুলত্রুটি অথবা সংশোধন করে দেওয়ার নামে সুবিধা নিয়ে থাকেন। আর সে সুবিধা নিতে গেলে মোবাইল বিকাশ নম্বরে লেনদেন করে থাকেন। আর সে মোবাইল নম্বটির হোয়াটসঅ্যাপে দিতে হয় আবেদনকারীর রেজিস্ট্রেশন ওআইডি নম্বর। এর মধ্যে একজন ১০৫ নম্বর কক্ষে মাইনুল কবির ও জুবায়ের আহমেদসহ কয়েকজন রয়েছে।
জুয়েল আরও বলেন, তাদের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট দু-চারজন দালাল কাজ করে থাকেন। সে-ই দালালরা আবেদনকারীর ফরমে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন আইডিতে ওআইডি নম্বরটি মাইনুল কবিরের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠান। এরপর তার মোবাইল বিকাশের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে লেনদেন করে থাকেন।
কয়েকজন ‘দালাল’ বলেন, পাসপোর্টের জন্য নতুন আবেদন ফাইল অফিসে জমা পড়লে সেসব আবেদন ফাইল ছোটখাটো ত্রুটি অথবা কোনো কাগজ না থাকলে আবেদন ফাইল জমা নেন না। সেই ফাইল নিয়ে যখন পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তিরা বাহিরে আসে তখন তাদের সঙ্গে কথা বলে সে দিনই তাদের ফিঙ্গার দিয়ে দিই। এতে তাদের সঙ্গে ১ হাজার ৫০০ থেকে শুরু করে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত চুক্তি করি। তা না হলে পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তিরা পরপর কয়েক দিন ঘুরে যখন পারে না, তখন আবার আমাদের (দালালদের) কাছেই আসতে হয়।
পাসপোর্ট অফিসের সামনে চা-পানের দোকানদার বলেন, এ পাসপোর্ট অফিসে বর্তমানে এখানকার স্থানীয় দালালদের দৌরাত্ম্যের চেয়ে অফিসের মাধ্যমে দূরের দালালরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় বসে পাসপোর্টধারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গুনে নিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় দালালরা মাঝেমধ্যেই ঝুঁকিতে থাকে। বর্তমানে দু-একদিন পর পরই অভিযান হচ্ছে; কিন্তু অফিসের মাধ্যমে যেসব দালাল রয়েছে তারা কোনো ঝুঁকির মধ্যে থাকে না। তারা শুধু মোবাইলের মাধ্যমে সমন্বয় করে যায়। যিনি পাসপোর্ট করবেন তার সঙ্গে সমন্বয় করে দেন পাসপোর্টধারীকে। এতে তথ্য ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ছাড়া কোথাও কোনো ধরনের দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না পাসপোর্টধারীদের।
সখীপুরে পাসপোর্ট করতে আসা এক নারী বলেন, আমার সঙ্গে ১০ হাজার টাকা চুক্তি হয়েছিল। শুধু একদিন এসে ফিঙ্গার দিয়েছিলাম। আজ এক মাস পরে এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাচ্ছি। আমি শুধু তার মোবাইল নম্বরে এবং সেই মোবাইল নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে ভোটার আইডি কার্ড, ছবি, বাবা-মায়ের ভোটার আইডি কার্ড দিয়েছিলাম। বাকি সব করে দিয়েছে।
সখীপুর থেকে পাসপোর্ট করতে আসা ওসমান আলীর ছেলে রাজমিস্ত্রি আরমান আলী ও তার বড় ভাই আকরাম আলী বলেন, সখীপুরের বড়চৌনা গ্রামের আনোয়ার হোসেন সব মিলে প্রায় ৯ হাজার টাকা নেবেন পাসপোর্ট করে দিতে। পাসপোর্ট অফিসে এসে ঘোরাঘুরিসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের স্থানীয় দালাল ধরে পাসপোর্ট করে নিচ্ছি।
তিনি বলেন, পাসপোর্ট করতে এসে নানা ধরনের কাগজপত্রের হয়রানি হতে না হয়। তাই স্থানীয় দালালের সঙ্গে চুক্তি করে নিয়েছি। যাতে কোনো ধরনের ঘোরাঘুরি করতে না হয়। শুধু একদিন পাসপোর্ট অফিসে এসে ফিঙ্গার দিয়ে গেলাম।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় দালাল আনোয়ার হোসেন পাসপোর্ট অফিসে আসেনি। তিনি অফিসের লোকের সঙ্গে কথা বলে দিয়েছেন। যার সঙ্গে কথা বলে দিয়েছেন, তার কাছে এসে আমাদের কাজ হয়েছে। তবে পাসপোর্ট অফিসে কার সঙ্গে কথা বলে দিয়েছেন সে কথা বলতে তিনি নারাজ।
একইভাবে ঘাটাইল উপজেলার সংগ্রামপুর ইউনিয়নের কামারচালা গ্রামের রিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমি কোনো দিন পাসপোর্ট অফিসে আসিনি। আজ ছেলের জন্য এই পাসপোর্ট অফিসে এসেছি। পাসপোর্ট অফিসেরই এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে ৮ হাজার টাকার মাধ্যমে তিনি তার ছেলের জন্য পাসপোর্ট করার চুক্তি করেন; কিন্তু তিনি পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তার নাম বলতে অস্বীকার জানান।
কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা নুরুল ইসলামের ছেলে ইমরান বলেন, আমি পাসপোর্টের আবেদন ফরম জমা দিতে গিয়ে ফেরত এসেছি। সেখানে আমার কাছে শিক্ষার্থীর প্রত্যয়নপত্র চায়। আমি বলেছি আমি এখন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। তাহলে কোথায় থেকে আমি আইডি কার্ড আনব। আমি আরও বলেছি আমার কাছে সার্টিফিকেট আছে সেটি দেখেন। তারা বলেন, শিক্ষার্থীর আইডি কার্ড লাগবে। এতে করে আমি ভোগান্তির শিকার হচ্ছি।
মির্জাপুর উপজেলার পাকুল্লা গ্রামের রনি বলেন, নিজেই ব্যাংক ড্রাফট থেকে শুরু করে আবেদন করেছেন। আবেদন ফরম জমা দিতে এসে ফেরত দিয়েছে। পাসপোর্ট অফিস থেকে বলা হয়েছে আমি কি কাজ করি। সেই কাজের জন্য একটি প্রত্যয়নপত্র লাগবে। এরপর পাসপোর্ট অফিস থেকে বাহির হলে কিছু ওতপেতে থাকা দালাল আমাকে সাহায্যের কথা বলেন। বিনিময়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা চেয়েছে। তাহলে আমার কাজের ওপর প্রত্যয়নপত্র লাগবে না। টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহায়ক মাইনুল কবির বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে সেটি আদৌ সত্য নয়।
সাধারণ গ্রন্থাগারের সহসভাপতি খন্দকার নাজিম উদ্দিন বলেন, পাসপোর্ট অফিসে দালাল রোধে মাঝে মধ্যেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিছুদিন পরপরই পাসপোর্ট অফিসের সামনে দালাল রোধে প্রশাসনের লোকজন এসে কিছু দালাল ধরে নিয়ে যায়। আবার কিছুদিন যাওয়ার পরে আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে অফিসের লোক ভালো হলে দালালমুক্ত এমনিতেই হয়ে যাবে বলে মনে করি। তবে তিনি আরও মনে করেন পাসপোর্ট অফিসের সব ধরনের দুর্নীতি বন্ধের ক্ষেত্রে অফিসের লোকের সদিচ্ছাটাই যথেষ্ট।
টাঙ্গাইল আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক জেবুন্নাহার পারভীন বলেন, আমাদের অফিসে লোকবল কম থাকলেও পাসপোর্টধারীদের সেবা দিতে সচেষ্ট রয়েছি। তবে তিনি মনে করেন পাসপোর্ট অফিসে বেশির ভাগ মানুষ পাসপোর্ট করতে তাদের আবেদনে তথ্য গোপন রাখেন। এতে আমাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে পাসপোর্ট আবেদনের জন্য বেশ কিছু চাপ ছিল। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ আবেদন পড়ত। এখন বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ আবেদন হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, পাসপোর্ট অফিসে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখা হবে। এ ছাড়াও আমার অফিসে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের আমি বদলি করে দিতাম; কিন্তু আমার হাতে বদলির সে ক্ষমতা নেই।
মন্তব্য করুন