লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল করিমের অর্থ আর প্রভাবের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্থানীয় করইতলা বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী। বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর সরকারি ও মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানা জমি দখল করে ‘টাকার কুমির’ বনে যান। যদিও জীবনের শুরুতে তিনি রিকশাচালক ছিলেন বলে জানা গেছে।
রোববার (১ ডিসেম্বর) তাঁতীদলের কমলনগর উপজেলা কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও করইতলা বাজারের ব্যবসায়ী রোকন উদ্দিন, ব্যবসায়ী নুর করিম, করইতলা বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম মোর্শেদ ও প্রতারণার শিকার মনির হোসেনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জানা যায়।
অভিযুক্ত নুরুল করিম কমলনগর উপজেলার চরলরেন্স ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। অভিযোগ রয়েছে, স্বাক্ষর জালিয়াতি করে তিনি নিজেকে সভাপতি হিসেবে পরিচয় দিতেন।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জীবনের শুরুতে নুরুল করিম রিকশাচালক ছিলেন। মাঝে মাঝে গাছ কাটার কাজ করতেন। ট্রলিও চালাতে দেখা গেছে তাকে। এরপর তিনি সৌদি আরব যান চাকরির খোঁজে। সেখান থেকে এসে তিনি আদম ব্যবসা শুরু করে। গ্রামের অসহায় মানুষকে চাকরির প্রলোভনে সৌদিসহ বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। বিদেশ গিয়ে অসহায় লোকগুলো আকামা না পেয়ে পালিয়ে গিয়ে কাজকর্ম করে আসছেন। তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক এমপি এবং আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলির অনুসারী ছিলেন। সেই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নুরুল করিম করইতলা বাজারের গণশৌচাগার ভেঙে দোকনঘর নির্মাণ করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমির ইজারাদারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন। এ ছাড়া বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর জমিও তিনি দখল করে নেন।
জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪০৮ বর্গফুটে জমি ইজারা নিয়ে ব্যবসায়ী রোকনের বাবা খোকন মিয়া বিসমিল্লাহ হোটেল ও বিসমিল্লাহ টেলিকমের ব্যবসা করে আসছিলেন। ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি খোকনের মৃত্যুর পর রোকন ব্যবসার হাল ধরেন। এর মধ্যেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটিতে আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল করিমের নজর পড়ে। এতে নুরুল করিমসহ তার দুই ছেলে ব্যবসায়ী রোকনের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠানটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা।
গত ৬ জানুয়ারি রাতে দোকানের কর্মচারীদের মারধর করে অস্ত্রের মুখে বের করে দেন। পরে দোকানের ক্যাশবাক্স থেকে নগদ ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা নিয়ে যান তারা। এ ছাড়া দোকানের মালামাল নষ্ট করে প্রায় ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি করে রোকনদের। এরপর থেকে দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নুরুল করিমদের দখলে ছিল। এ ঘটনায় ৮ ফেব্রুয়ারি রোকন বাদী হয়ে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কমলনগর আদালতে নুরুল করিমসহ তার দুই ছেলে জয়নাল ও আমির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। পরে আদালতের বিচারক মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেসটিগেশন নোয়াখালী কার্যালয়কে নির্দেশ দেয়।
ব্যবসায়ী রোকন উদ্দিন বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল করিম আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে রাখে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকার পতনের পর স্থানীয় বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বুঝে নিই। এর মধ্যেই সেই নুরুল করিম স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছে। আমাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে আসছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি ইজারাসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সব প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।
প্রতারণার শিকার মনির হোসেন বলেন, নুরুল করিম প্রতারক। আদম ব্যবসার নামে লোকজনকে বিদেশ নিয়ে প্রতারণা করছেন। ৪ লাখ টাকা নিয়ে আমার ছেলে রাশেদকে সৌদি আরব হোটেলের ভিসা দিয়ে পাঠান তিনি। কিন্তু মালিক রাশেদকে আকামা দেয়নি। আকামা চাইলে মালিক তাকে মারধর করত। এতে ছেলেটা পালিয়ে গেছে। আমার ছেলে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এ ঘটনায় তিনি স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
করইতলা বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম মোর্শেদ বলেন, আমাদের বাজারে একটি গণশৌচাগার ছিল। বিগত সরকারের সময় একটি চক্র তা ভেঙে দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া দেয়। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু বিগত সরকারের ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে গণশৌচাগার দখল করে দোকানঘর নির্মাণ করে। এ ঘটনায় আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর হস্তক্ষেপ চাচ্ছি।
অভিযুক্ত নুরুল করিম বলেন, আমি কাউকে কোনো হয়রানি করছি না। আইনিভাবে আমি লড়ছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মিথ্যা।
চরলরেন্স ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে গণশৌচাগার দখল করে নুরুল করিম দোকান ঘর নির্মাণ করে। আদম ব্যবসার নামে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা তার প্রধান কাজ। জীবনের শুরুতে রিকশাচালক থাকলেও প্রতারণা আর দখল বাণিজ্য করে এখন তিনি কোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে পরিষদে অন্তত ১০ হাজার অভিযোগ রয়েছে। এখনো টাকা দিয়ে সবাইকে ম্যানেজ করছে। প্রশাসনকে ভুল বুঝিয়ে মানুষকে হয়রানি করে আসছে।
কমলনগর থানার ওসি তৌহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান,আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে দখলসহ প্রভাব বিস্তারের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে শুনেছি। তবে কেউ কাগজপত্রাদিসহ সুনির্দিষ্টি কোনো অভিযোগ দেয়নি থানায়। এমন কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন