‘বাবা আমাকে বাঁচাও! আমি বাঁচতে চাই। দাদন ব্যবসায়ী (সুদ কারবারি) জ্যোতিষ চন্দ্র শর্মার মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের কারণে আমি স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে মৃত্যুশয্যায় রয়েছি। সে আমাদের পরিবার শেষ করে দিয়েছে। তার কারণে আজ আমরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।’
এই প্রতিবেদককে দেখে মেহেরুন নেছার দুচোখ জলে ভরে ওঠে। করুণ কণ্ঠে তিনি এসব কথা কালবেলার কাছে বলতে থাকেন।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মেহেরুন নেছা। একসময় তিনি পরিবার পরিকল্পনায় চাকরি করতেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন তিনি। চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে আজ তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
মেহেরুন নেছা বলেন, ‘জ্যোতিষের কাছ থেকে আমি প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে ২ লাখ টাকা নিই। সে ২ লাখ টাকা দেওয়ার সময় আমার কাছ থেকে আমার মৃত স্বামীর (বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেন) সরকারি ভাতার স্বাক্ষর করা চেক বই হাতিয়ে নেয়। এই ভাতার চেক বই দিয়ে সে সাত মাস ব্যাংক থেকে টাকা তোলে। এরপর আমি একটি ব্যাংক থেকে কিছু টাকা লোন সংগ্রহ করি এবং জ্যোতিষকে দুদিনে দেড় লাখ করে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করি। তখন সে চেক বইটি আমাদের ফেরত দিলেও কৌশলে চেকের একটি পাতা তার কাছে রেখে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন পর জ্যোতিষ আমার বাসায় এসে সুদের আরও টাকা দাবি করে। আমি তখন তাকে বলি, তোমায় তো সুদ-আসলে সব টাকা পরিশোধ করেছি। এখন আবার কীসের টাকা চাও? তুমি তো অন্যায়ভাবে র সরলতার সুযোগে আমাদের কাছ থেকে উচ্চ সুদহার দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে প্যারালাইজড রোগী বানিয়ে দিয়েছ। আমার কাছে আর কোনো টাকা নেই। তোমার দ্বারা আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। এখন আর এক পয়সাও দিতে পারব না।
কিছুদিন পর জ্যোতিষ চন্দ্র শর্মা তার কাছে থাকা আমাদের একটি পুরোনো চেক বইয়ের পাতা ফিরোজা নামে এক নারীকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁও আদালতে ১২ লাখ টাকার মামলা করে। অথচ আমি ফিরোজা নামের ওই নারীকে কখনো দেখিইনি। তার সঙ্গে আমার এক পয়সা লেনদেনও হয়নি। তাকে কোনো চেকের পাতাও দিইনি। আমি চেক বই দিয়েছি জ্যোতিষের কাছে। সে আমার কাছ থেকে আরও টাকা হাতিয়ে নিতে ওই নারীকে ব্যবহার করে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করেছে।’
এর আগেও একই ব্যক্তির দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন অভিযোগ করে মেহেরুন নেছা বলেন, ‘২০১৪ সালে জ্যোতিষের কাছ থেকে আমি ২০ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে গ্রহণ করি। এরপর মাঝেমধ্যে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা নিই। সে এক দিন এসে বলে, ‘আপনার সুদ-আসলে ১ লাখ টাকা হয়েছে।’ এ কথা বলে জোর করে আমার বেতনের স্বাক্ষর-সংবলিত খালি চেকের পাতা নিয়ে যায়। মাস কয়েক পর এসে বলে, ‘আপনার সুদ-আসলে এখন ১২ লাখ টাকা হয়েছে।’ এই ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করতে চাপ দিতে থাকে। বাড়িতে লোক পাঠিয়ে আমাকে ও পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিতে থাকে এবং জেল-জরিমানার ভয় দেখায়। আমরা তার কৌশলের কাছে অসহায় হয়ে পড়ি।’
তিনি বলেন, ‘এলাকায় জ্যোতিষের এতই প্রভাব যে, বিভিন্নজনের কাছে নালিশ করেও প্রতিকার পাইনি। তার প্রভাব ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কাছে সবাই অসহায় হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে আমি চাকরির অবসর পেনশনের ১৮ লাখ টাকা উত্তোলন করি। জ্যোতিষের চাপের মুখে তাকে সুদের জন্য সাড়ে ৯ লাখ টাকা দিয়ে দিই।’
মেহেরুন নেছার প্রতিবেশী আব্বাস আলী কালবেলাকে বলেন, ‘জ্যোতিষ শর্মা একজন সুদারু। সে দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় সুদের ব্যবসা করে আসছে। জ্যোতিষ তার স্ত্রীসহ আত্মীয়স্বজন বাদী করে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে আদালতে প্রায় ২০টি মামলা করেছে। আমি আদালত থেকে ২০টি মামলার আরজি সংগ্রহ করেছি। একেকজনের বিরুদ্ধে সে ১৫ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ টাকার মিথ্যা মামলা দিয়েছে। মেহেরুন নেছা চেক বই ও চেকের পাতা দিয়েছিলেন জ্যোতিষ শর্মাকে। কিন্তু সে চেক বইয়ের একটি পাতা ফিরোজা বেগমকে দেয়। তাকে দিয়ে জ্যোতিষ শর্মা মেহেরুন নেছার বিরুদ্ধে ১২ লাখ টাকার একটি মিথ্যা মামলা করায়। তার সুদের কারবারি চক্রে পড়ে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়েছে। আমি জ্যোতিষের শাস্তি চাই।’
স্থানীয় তরুণ আমিরুল বলেন, ‘মেহেরুন নেছা একজন ভালো মানুষ। তিনি জ্যোতিষ শর্মার কাছ থেকে বিপদে পড়ে সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়েছেন। আজ জ্যোতিষের কারণে মেহেরুন নেছা স্ট্রোক করে বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। এই সুদ কারবারিদের হাত থেকে সমাজের মানুষকে রেহাই দিতে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।’ মেহেরেুন নেছার ছেলে আলিমুলা আল রেজা বলেন, আমরা জ্যোতিষের কাছ থেকে সুদের বিনিময়ে টাকা গ্রহণ করি। কিন্তু একসময় সে জানায় সুদ-আসলে ১২ লাখ টাকা হয়েছে। এই টাকা পরিশোধ করতে চাপ দিতে থাকে। আমার মা পেনশনের টাকা তুলে তাকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। এরপরও সে নানাভাবে আমাদের হয়রানি করতে থাকে। জ্যোতিষ শর্মার ফাঁদে পড়ে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। সরকারের কাছে ন্যায়বিচার দাবি করছি।’
পঞ্চগড় জেলা জজ কোটের অবসরপ্রাপ্ত পেশকার বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী প্রধানপাড়া গ্রামের খাদেমুল করিম বলেন, ‘আমি জ্যোতিষ চন্দ্র শর্মার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছি। প্রতি লাখে মাসে ৫ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে নিই। ১৪ থেকে ১৫ মাস ধরে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা করে সাড়ে ৩ লাখ টাকার সুদ দিয়ে আসছি। এরপর সে আসল ৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে চাপ দিতে থাকে। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় টাকা দিতে পারছিলাম না। একটি সালিশে উপস্থিত হয়ে কিছুদিন সময় চাই। কিন্তু জ্যোতিশ চন্দ্র শর্মা তার আত্মীয় মনতোষ শর্মাকে বাদী বানিয়ে আমার বিরুদ্ধে ঠাকুরগাঁও আদালতে ১২ লাখ টাকার মিথ্যা মামলা করে। সে আমার মেয়ের জামাইয়ের নামেও ২০ লাখ টাকার মিথ্যা মামলা করে। আমরা তার নির্যাতন থেকে মুক্তি চাই।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, জ্যোতিষ শর্মা বহুদিন ধরে পঞ্চগড় জেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় সুদের কারবার পরিচালনা করে আসছে। সহজ-সরল মানুষ টার্গেট করে সে এ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। সুদে-আসলে মূল টাকা আদায় করার পরও চেকের মামলা দিয়ে হয়রানি করে। জ্যোতিষ শর্মা নিজে চারটি ও তার স্ত্রীকে বাদী করে অনেক ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করেছে, এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি জ্যোতিষ শর্মার কাছ থেকে সুদের বিনিময়ে টাকা গ্রহণ করার পর তার মানসিক নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার কারণে ভূদেব চন্দ্র নামের এক ব্যক্তির আত্মহত্যা করার অভিযোগ উঠেছে।
দাদন ব্যবসার পাশাপাশি জ্যোতিশ চন্দ্র শর্মা আটোয়ারী উপজেলার বটতলী বালিকা বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, সে একজন অর্থলোভী দাদন ব্যবসায়ী। তার কারণে বহু পরিবার পথে বসেছে। তার কাছ থেকে মুক্তি পেতে ভুক্তভোগী মেহেরুন নেছা পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জ্যোতিষ চন্দ্র শর্মা কালবেলার কাছে প্রথমে সুদ কারবারের বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে তিনি বলেন, ১০ থেকে ১২ জনের কাছে আমার ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা দেওয়া আছে। লাখে ৫ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে মানুষকে টাকা দিয়েছি। মেহেরুন নেছার কাছ থেকে সাড়ে ৯ লাখ টাকা গ্রহণের কথাও কালবেলার কাছে স্বীকার করেন তিনি। জ্যোতিশ চন্দ্র শর্মা কৌশলে অন্যজনকে দিয়ে মেহেরুন নেছার বিরুদ্ধে ১২ লাখ টাকার মামলা ঠাকুরগাঁও আদালতে করেছেন বলেও কথোপকথনে তা উঠে আসে।
এদিকে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদীঘি এলাকার দাদন ব্যবসায়ী রাকিবুল ইসলাম জানির অত্যাচারে শত শত মানুষ নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। তার অত্যাচারে বহু মানুষ বসতভিটা ছেড়ে এলাকাছাড়া হয়েছেন। রাকিবুলের অত্যাচারে পঞ্চগড়ের বাপ্পি গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী আত্মহত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রাকিবুলের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে ময়দানদীঘি বাজারে স্থানীয়রা মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছেন।
পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে বেড়েছে দাদন ব্যবসায়ীদের দাপট। অসহায় ও হতদরিদ্র মানুষকে অর্থ সহযোগিতার নামে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। মূলধনের দ্বিগুণ টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে অসহায় পরিবারগুলো। এতে সহায়-সম্বল হারিয়ে অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন এলাকা থেকে। অনেকে আবার আয়-রোজগারের গৃহপালিত পশু বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করছেন।
এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীরাও তাদের ব্লাঙ্ক চেক জমা রেখে বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছেন দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। মাস শেষে টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাদেরও হতে হয় হয়রানির শিকার। এভাবেই ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সুদের টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। তাই এসব দাদন ব্যবসায়ীকে রুখে দিতে উপজেলা প্রশাসন, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও সমবায় অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপ চায় সচেতন মহল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পঞ্চগড় জেলা সমবায় কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল বলেন, ব্যক্তিগত দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদের করার কিছু নেই। তবে কেউ যদি আমাদের সমবায়ের কথা ব্যবহার করে, তবে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী বলেন, ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন