দিনভর খুটখাট শব্দ। কখনো হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠোকা, কখনো আবার দড়ি দিয়ে বেঁধে গুন ও আলকাতরা টানা। থেমে থেমে চলছে করাত দিয়ে কাঠ কাটা। আর এভাবেই কারিগরের যত্নে তৈরি হচ্ছে একেকটি নৌকা। কাঠের মান আর শৈল্পিক সৌন্দর্যের কারণে সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটায় তৈরি নৌকার কদর দেশজুড়ে।
খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ঘেঁষে পাটকেলঘাটা বলফিল্ড মোড় থেকে পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত গড়ে উঠেছে এ নৌকা পল্লি। সেখানে সারা বছরই নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন কারিগররা। তবে সম্প্রতি সুন্দরবনে দস্যুদের তৎপরতা বাড়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাতক্ষীরায় নৌকা শিল্পেও।
মেসার্স ঐশী নৌকা কারখানার মালিক শেখ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে নৌকা তৈরি করি। তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ায় বেচা-বিক্রি বেশি হয়েছিল। বর্তমানে এখানে গড়ে উঠেছে নৌকার হাট। ছোট নৌকার মূল্য ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার। আর ৪৫ হাত লম্বা ইঞ্জিনচালিত নৌকার ১৭ থেকে ১৮ লাখ টাকা।’
তিনি বলেন, ‘বন্যা ও অতিবৃষ্টি হলে নৌকার চাহিদা তুলনামূলক বাড়ে। তখন দূরদূরান্ত থেকে অনেক মানুষ নৌকা কিনতে আসে। তাদের চাহিদানুযায়ী সরবরাহ করতে অনেক সময় হিমশিম খেতে হয়। কারণ, নৌকা তৈরির প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগাড় সময়সাপেক্ষ।’
তথ্য বলছে, নদীমাতৃক বাংলাদেশে একসময় যোগাযোগের একমাত্র সহজ মাধ্যম ছিল নৌকা। কালের বিবর্তন আর স্থলপথের উন্নয়নে আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে। তার পরও টিকে রয়েছে শিল্পটি। সাগর, নদনদী, খাল-বিল ও মাছের ঘেরের জন্য চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি করা হয় এ নৌকা পল্লিতে। উত্তরাধিকার সূত্রে পেশাকে আঁকড়ে ধরে প্রতিনিয়ত নিপুণ কারুকাজে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন আকারের নৌকা। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব নৌকার চাহিদা ব্যাপক।
যশোরের শার্শা থেকে নৌকা কিনতে আসা কাওসার আলী জানান, ‘নৌকায় করে মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করি। পাটকেলঘাটায় নৌকার খ্যাতি শুনে নৌকা কিনতে এখানে এসেছি।’
যুগীপুকুরিয়া এলাকার বাসিন্দা কারিগর ইমন জানান, ‘তিনজন মিলে একটি নৌকা তৈরিতে দুদিন সময় লাগে। নৌকাপ্রতি মজুরি পাবেন ৫ হাজার টাকা। মেহগনি, খই, চম্বল ও লম্বু গাছের কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরি করি। এসব কাঠ দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকলেও নষ্ট হয় না। এ কারণে এসব কাঠের তৈরি নৌকার চাহিদা বেশি।’
আশাশুনি উপজেলার দুর্গাপুরের বাসিন্দা নৌকা কারিগর শেখ রানা আলী বলেন, ‘সুন্দরবনে জলদস্যুতা বাড়ায় এ বছর নৌকার চাহিদা কম। জেলেরা সুন্দরবনে গেলেই জলদস্যুরা তাদের কাছ থেকে নৌকা ছিনতাই করে এবং মুক্তিপণ নিচ্ছে। মুক্তিপণ না দিলে তাদের আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে। যে কারণে অন্যান্য বছর এ সময়টায় জেলেরা নৌকা কিনলেও এবার মাছ ধরতে কম যাওয়ায় নৌকাও কম কিনছে। তাই কমেছে তৈরিও।’
এদিকে, শৈল্পিক সৌন্দর্যের কারণে দেশজুড়ে কদর বাড়া এই বাজার তৈরি হচ্ছে সুন্দরবনের জেলেদের জন্য সামুদ্রিক নৌকাও। এগুলো আকারে বড়। বর্তমানে কয়েকজন করে কারিগর আলাদা ভাগে ভাগ হয়ে তৈরি করছেন এ ধরনের বেশ কয়েকটি নৌকা।
সামুদ্রিক নৌকা তৈরিরা কারিগর শেখ হেলাল হোসেন ও সদরুল গাজী জানান, ‘চার বা পাঁচজন মিলে তৈরি করতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে। একটি নৌকা তৈরি করলে ২ লাখ টাকা পাই। সামুদ্রিক নৌকাগুলো মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি করলে সব থেকে মজবুত হবে। সমুদ্রের ঝড়-তুফানের মধ্যে চলাচলের উপযোগী করেই তৈরি করা হয় নৌকাগুলো।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপব্যবস্থাপক গৌরব দাস বলেন, ‘নৌকা তৈরি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের আওতায় পড়ে। কিন্তু তারা কখনোই আমাদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে যোগাযোগ করে না। যদি করত তাহলে তারা ঋণসহ প্রয়োজনীয় সব সহায়তা পেতে পারে।’
মন্তব্য করুন