গাইবান্ধা সদরের সাহাপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আজিম উদ্দিন (৬৫) তুলসীঘাট বাজারে ২০০৭ সালে চালের ব্যবসা করতেন। হঠাৎ ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার খরচ নিয়ে বেকায়দায় পড়েন। এদিকে চালের ব্যবসায়ও ধস নামে। একদিন তার স্ত্রী জরিনাও অসুস্থ হয়ে পড়েন পা ফোলা রোগে।
আজিম উদ্দিন এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। নিজে ও স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ এবং ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে এলাকার দুই দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন। দাদন ব্যবসায়ী সামাদের কাছ থেকে ৩০ হাজার ও নজরের কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকা ঋণ নেন। ১০ শতাংশ হারে সুদ নিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার সুদ একসময় গিয়ে দাঁড়ায় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকায়।
এ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ২০২৩ সালে আত্মসম্মানের ভয়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান আজিম। পরে বাড়ি ফিরলেও সে টাকা পরিশোধ করার জন্য শেষ সম্বল ভিটেমাটি ও জমিজমা সব বিক্রি করে দেন। এরপর ভাইয়ের কাছে বিক্রি করা জায়গায় তার আশ্রয় মেলে পরিবারসহ।
এভাবেই অতিকষ্টে দিন পার হচ্ছে আজিম উদ্দিন ও তার স্ত্রী জরিনার। বর্তমানে তার ছেলে নাসির (৩২) ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। তার পাঠানো সামান্য টাকায় কোনোরকমে চলে তাদের সংসার।
আজিম উদ্দিনের স্ত্রী জরিনা বলেন, সংসারের আয়-উন্নতি না থাকায় আর সব জমিজমা ও বাড়ির ভিটেমাটি বিক্রি করে দেওয়ায় কোনো শখ-আহ্লাদ পূরণ হয় না আমাদের। খুব কষ্টে আছি। দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে এভাবেই নিঃস্ব হয়েছি আমরা।
গাইবান্ধার চার উপজেলার চিত্র একই। সদর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সাদুল্যাপুর উপজেলায় দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে এক ধরনের দিশাহারা হতদরিদ্র এসব মানুষ। শহর, গ্রাম কিংবা চরের মানুষ অসহায়- কেউ বাদ যাচ্ছেন না। দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে তারা হারাচ্ছেন জমিজমা ও ভিটেমাটি। একসময় দেশান্তরী হতে হচ্ছে তাদের।
দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে জেলা পুলিশ ও প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও, তেমন কোনো ভূমিকা বা প্রতিকার পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। ফলে দিন দিন এসব দাদন ব্যবসায়ীর দাপট বাড়ছে। তারা মুনাফা (সুদ) দিয়ে একেকজন আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে।
এসব ব্যবসায়ী ঋণ ও চড়া সুদের ফাঁদে ফেলে পরিশোধে ব্যর্থ হলে বাড়ি থেকে নিয়ে যাচ্ছে গরু, ছাগল, স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র। এমনকি ঘরের চালের টিনও খুলে নেওয়ার নজির আছে। আর যার কিছুই নেই, তাকে আবার দাদন বাহিনী কর্তৃক হামলা এবং মামলা দেওয়ারও অভিযোগ আছে।
সাঘাটা উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের আহেনা বেওয়ার (৬০) কান্না যেন থামছেই না সন্তানের জন্য। পাঁচ বছর আগে তার সন্তান আবুল কালাম আজাদ তাকে না জানিয়ে গ্রামের বেশ কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে হাজারে ১০০, যা ১০ শতাংশ হারে; কিন্তু মাস শেষে সুদ না দিলে ওই সুদের ওপর ফের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ ধার্য হয়। ওই সময় ৮ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। বর্তমানে সুদ-আসলে হয়েছে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকা। এই টাকা পরিশোধ করেননি তিনি। হঠাৎ তার বাবা মারা গেলে জানাজা দিতে আসেন তিনি। এ সময় দাদন ব্যবসায়ীরা তাকে ধরে মারধর করে এবং টাকা না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
এ নিয়ে আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে দাদন ব্যবসায়ীরা একটি মামলাও করে। এরপর বাড়ি থেকে পালিয়ে যান আজাদ। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। সন্তানকে একনজর দেখার জন্য দিন-রাত কান্নাকাটি করেন আহেনা বেওয়া।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, আহেনা বেওয়া সারা দিন তার ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকেন। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না। অভাবের কারণে এসব মানুষ ঋণ নেয়। পরে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় একেকটি পরিবার।
আহেনা বেওয়ার কাছে ছেলের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার গল্প শুনতে চাইলে কালবেলা প্রতিবেদকের সামনেই অঝোরে কান্না শুরু করেন। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে অনেক দিন হলো দেখি না বাবা। ছেলেকে দেখতে খুব মন চাইছে। তবে সুদারুদের অত্যাচারে ছেলেটা আর বাড়ি আসে না। এই নিষ্ঠুর দাদন ব্যবসায়ীদের চাপে আজ আমার ছেলে ও ছেলের স্ত্রী-সন্তান আমার কাছে নেই। এখন বড় ছেলের কাছে থেকে কোনোরকম বেঁচে আছি।
শুধু আজিম উদ্দিন, জরিনা, আহেনা বেওয়াই নন, সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের বাটি গ্রামের সাবিনা বেগমের স্বামী আট বছর আগে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নেন। পরে পাহাড়সম ঋণের চাপ সইতে না পেরে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন।
এ ছাড়া গাইবান্ধার আলোচিত জুতা ব্যবসায়ী হাসান আলীর আত্মহত্যা দাদন ব্যবসায়ীর চাপের জন্য হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে হত্যা মামলা হলেও পরে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এতে আসামিরা বেকসুর খালাস পায়। তবে বিচার পায়নি এখনো ওই পরিবার।
এ ছাড়া গত ১২ নভেম্বর রুহুল আমিন নামের এক দাদন ব্যবসায়ী সাদুল্যাপুরের বড় জামালপুর প্রাইমারি স্কুল-সংলগ্ন এলাকার এক দোকানিকে মাত্র ৬ হাজার টাকা ঋণ দেয়। এ টাকা ফেরত না পেয়ে দোকানের ৩৭ হাজার টাকা দামের ফ্রিজ নিয়ে যায়। এ ঘটনায় সাদুল্যাপুর থানায় একটি অভিযোগ করেন দোকানি রাজেক মিয়া।
সাঘাটা উপজেলার রামনগর চরের কৃষক আলামিন কালবেলাকে বলেন, সুদের টাকা নিয়ে কৃষিকাজ করি। কিন্তু চিন্তা শেষ হয় না আমাদের। সরকারিভাবে সহজ ঋণের ব্যবস্থা করলে উপকার হতো। এখন সুদের ওপরে ঋণ নিয়ে জমিতে পরিশ্রম করে যা ফসল ফলাই, তার অর্ধেক দিতে হচ্ছে দাদন ব্যবসায়ীদের। না দিলেই চলে হুমকি-ধমকি ও লুটপাট।
তিনি আরও বলেন, এসব দাদন ব্যবসায়ীর সঙ্গে থাকে মোটরসাইকেল বাহিনী। টাকা পরিশোধ না করলে তারা দলবেঁধে এসে মারধর করে। জিনিসপত্র নিয়ে যায়। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ করেন কৃষক আলামিন।
ফুলছড়ি উপজেলার বাগুরিয়া গ্রামের রমিজ আলী বলেন, প্রশাসন যদি এসব দাদন ব্যবসায়ীর তালিকা করত, তাহলে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হতো। প্রশাসন তো কানই নাড়ায় না! তাই এরাও পেশিশক্তি দেখায়।
গাইবান্ধা সদরের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য যদি সহজলভ্য ঋণ ও বেকার সমস্যার সমাধান করা হতো, তাহলে এসব দাদন ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্য কমে আসত।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রবীর চক্রবর্তী কালবেলাকে বলেন, দাদন ব্যবসায়ীরা হলো সমাজের সামাজিক ব্যাধি। এদের নির্মূল করতে প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। দ্রুত দাদন ব্যবসায়ীদের তালিকা করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার দাবি করছি।
তিনি আরও বলেন, এর আগে দাদন ব্যবসায়ীর চাপে আলোচিত জুতা ব্যবসায়ী হাসান আলী আত্মহত্যার ঘটনায় কোনো বিচার হয়নি। প্রশাসনকে দাদন ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করতে হবে। সে সঙ্গে সাধারণ মানুষকে দাদন ব্যবসায়ীর ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এদের খপ্পর থেকে হতদরিদ্র মানুষকে উদ্ধার করা প্রশাসনের কাজ।
দাদন ব্যবসায়ীরা সমবায় সমিতির নাম দিয়ে গোপনে দাদন ব্যবসা করে থাকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলার সমবায় সমিতির কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, কোনো দাদন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির নাম ব্যবহার করে দাদন ব্যবসা করছেন, এ বিষয়ে জানা নেই। এ রকম কোনো তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেব।
দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার মো. মোশাররফ হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, কেউ যদি দাদন ব্যবসায়ীদের দ্বারা আক্রান্ত হন, তবে ভুক্তভোগী অভিযোগ করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো দাদন ব্যবসায়ীর তালিকা নেই। অভিযোগ করলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন