‘মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তাই ১২ বছর আগে সরকার মোক জাগা দিয়া টিনের ঘর বানিয়া দিছিল। পেটের দায়ে মানুষের বাড়িত কাজ করি। তাই ঢাকাত গেছুনু কাজ করবার। ১০ বছর ধরে ভালোই আছিনু। হঠাৎ শুননু, মোর ঘরের তালা ভাঙে দখল করে নিছে। এই বয়সে হামার শেষ আশ্রয়টাও ওরা কাইড়ে নিছে।’
অশ্রুশিক্ত চোখে কথাগুলো বলছিলেন ৭০ বছরের বৃদ্ধা রহিমা বেগম।
জানা গেছে, ২০১২ সালের অক্টোবরে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘বেলোওয়া নয়নদীঘি গুচ্ছ গ্রাম’ প্রকল্প চালু করা হয়। এতে পুনর্বাসিত করা হয় ৫০টি ভূমিহীন পরিবারকে। জীবিকা নির্বাহের জন্য ভূমিহীন পরিবারসহ আশপাশের ৩০০ জনকে দেওয়া হয় ৩৩ বিঘার একটি পুকুর। এই পুকুরটি বেলোওয়া নয়নদীঘি গুচ্ছগ্রাম মৎসজীবী সমবায় সমিতি -১ এর আওতায় পরিচালনা করা হয়।
এই সমিতির সভাপতি মুকুল এবং সাধারণ সম্পাদক বক্কর। চেয়ারম্যানের মনোনীত হওয়ায় এখানে তার অদৃশ্য ইশারায় চলে মুকুল, বক্কর ও আকবার বাহিনীর শাসন। সুযোগ বুঝে ঘর দখল করে তালা দেওয়ায় তাদের কাজ। আর প্রতিবাদ করলেই দেখানো হয় ভয়ভীতি অথবা করা হয় শারীরিক নির্যাতন।
বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে ভুক্তভোগী কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে হাজেরা বেগম নামে একজন জানান, আমি এখন পরচুলা কারখানায় কাজ করি। এর আগে আমি খুব অসহায় ছিলাম। মাথা গোঁজার জায়গা না থাকায় আমার বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও বাবার বাসায় থাকতাম। পরে আমাকে ২০১২ সালে এখানে জায়গাসহ টিনশেডের একটি ঘর দেওয়া হয়। বাকি ফাঁকা জায়গায় ৫৬টি গাছ লাগায়। রাতে থাকি আর দিনের বেলায় কারখানায় কাজ করি। হঠাৎ শুনতে পাই, মুকুল আমার ঘরে তালা দিয়েছে। তার কাছে গেলে, ব্যাপারটা পরে দেখা হবে বলে বিদায় করে দেয় সে।
তিনি বলেন, পরে চেয়ারম্যান, চেয়ারম্যানের কাছের লোক আকবার, ইউএনও স্যার, সাবেক এমপি সবার কাছে গিয়েছি। কিন্তু আমার ঘর ফেরত পাইনি। প্রতিবাদ করায় একদিন আটকে রেখে আমাকে রাত ৮ থেকে ১২ পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়েছে। পরে পুলিশ এসে আমাকে উদ্ধার করে।
ঘরহারা নূর ইসলাম নামে আরেক বৃদ্ধ জানান, পেটের দায়ে এই বয়সে ঢাকায় গিয়ে কাজ করি। আমি খুব অসহায়। আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। এখন মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে থাকছি। কাজের জন্য ঢাকায় থাকি আর সুযোগ পেলে এসে আমাকে দেওয়া ঘরে থাকতাম। দুই বছর হলো আমার ঘরে তালা দিয়ে দখল করা হয়েছে। আমি আমার ঘর ফেরত চাই।
এদিকে নয়নদীঘি গুচ্ছগ্রাম মৎসজীবী সমবায় সমিতি -১ এর সভাপতি মুকুল একাই দুটি ঘর দখলে নিয়েছেন। ঘটনাস্থলে মুকুলকে পাওয়া না গেলেও তার পক্ষে তার স্ত্রী সম্পা বলেন, অসহায় হিসেবে সরকার আমাদেরকে ঘরগুলো দিয়েছে থাকার জন্য। যারা অভিযোগ করেছে তারা ঘর পাওয়ার পরও কেউ এখানে থাকেন না। একে একে ইউএনও স্যার তিনবার তদন্ত করেছে। পরে চেয়ারম্যান, মেম্বার ও এখানকার সভাপতি মিলে তাদের ঘরগুলো বাতিল করে।
এ সময় সভাপতি মুকুলের স্ত্রীকে আরেক জনের ঘর দখলে নিয়ে নিজেরা ব্যবহার করছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার থেকে একটি ঘর পেয়েছি আর আমার সন্তানরা বড় হয়ে গেছে তাই তাদের জন্য আরেকটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করেছি।
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবিরুল ইসলাম প্রধান মুঠোফোনে ঘর দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, আমি সেই সময় ওমরাহ পালনে গিয়েছিলাম। এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এটা ভালো জানে আগের ইউএনও রাফিউল ইসলাম ও সমবায় অফিসার প্রদীপ। যাদেরকে বের করে দেওয়া হয়েছে শুনেছি তারা এই ঘরগুলোতে থাকতেন না। তাদের নতুন ঘর আছে। এখানে না থাকার কারণে উপজেলা প্রসাশন ব্যবস্থা নিয়েছে। এই বিষয়ে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানান, পাঁচজনের একটা অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন