কর্মক্ষেত্রে সকাল থেকে ডিউটি শেষ করে বাসায় গিয়েছেন রাত ৮টায়। রাত ১০টায় হাসপাতাল থেকে হঠাৎ ফোন—‘মুমূর্ষু রোগী আছে, ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে।’ একমুহূর্ত দেরি না করে ছুটে গিয়েছেন হাসপাতালে। নিজের শরীরের দিকে না তাকিয়ে দিনরাত দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন রোগী নিয়ে।
মানবসেবায় এভাবেই নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন অ্যাম্বুলেন্স চালক আশরাফুল আলী। গত ১৬ অক্টোবর রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হয় কালবেলার প্রতিষ্ঠবার্ষিকী। সেই অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। সেখানেই তার দিনরাত ছুটে চলার ও নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন আশরাফুল।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে যোগ দেন আশরাফুল। তখন থেকেই অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী বহন শুরু করেন তিনি। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কর্মরত। দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে আশরাফুল নিজেকে সঁপে দেন মানবসেবায়।
কালবেলার সঙ্গে আলাপকালে আশরাফুল আলী বলেন, জীবনে ইচ্ছা ছিল মানবসেবা করব। কিন্তু অভাব-অনটনের সংসারে ওভাবে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। পরের উপকারে আত্মনিয়োগ করতে পারিনি। তবে কর্মের মাধ্যমে জীবনের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সেবার চেষ্টা করছি এখন।
তিনি বলেন, ৩১ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্সে হাজারো রোগী বহন করেছি। কখনো নিজে অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও দূরপ্রান্তে অসুস্থ রোগী নিয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে রোগী নিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারতাম না। আর বলেই বা কী হবে? তার চেয়ে আরও বেশি অসুস্থ রোগী যে আমার নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্সেই ছিলেন।’
আমার কাজই মুমূর্ষু রোগী বহন করা। রোগী বহনের এমন অনেক স্মৃতিময় ঘটনা আছে, যেগুলো এই অনুষ্ঠানে বর্ণনা করে শেষ করতে পারব না। আমার কর্মক্ষেত্রে সকাল থেকে ডিউটি শেষ করে বাসায় গিয়েছি রাত ৮টায়। রাত ১০টায় হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়ে বলছে, মুমূর্ষু রোগী আছে, ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। একমুহূর্ত দেরি না করে, নিজের শরীরের দিকে না তাকিয়ে ছুটে বেড়িয়েছি রোগী নিয়ে। এমন অসংখ্য দিন আছে আমি অসুস্থ অবস্থায় মুমূর্ষু রোগী নিয়ে তার জীবন বাঁচাতে ছুটেছি এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে।
আশরাফুল বলেন, চাকরি নয়, আমি যে পেশায় আছি, সেটিকে সেবা হিসেবে নিয়েছি। আমার সহযোগিতায় একজন মানুষ যাতে বেঁচে ফেরেন, সেই চেষ্টাই আমি করে যাচ্ছি। বাকি জীবনে যাতে মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে পারি, সেটাই আমার আশা।’ তিন সন্তানের জনক আশরাফুল আলীর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। দুই মেয়ে এখন কলেজে পড়াশোনা করছে। আর ছোট ছেলেকে দিয়েছেন হাফেজিয়া মাদ্রাসায়। স্ত্রী দেখাশোনা করেন সংসার।
১৬ অক্টোবর দুপুরে রাজশাহীতে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা ও কেক কাটা অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হন অ্যাম্বুলেন্স-চালক আশরাফুল আলী। মানবসেবায় অবদান রাখায় অনুষ্ঠানে তাকে দেওয়া হয় বিশেষ সম্মাননা। তার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীরসহ অন্য অতিথিরা।
এমন সম্মাননা পেয়ে আশরাফুল আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়ে বলেন, ‘আমার অনুভূতি অত্যন্ত চমৎকার। কালবেলার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার মতো একজন ব্যক্তিকে অনুষ্ঠানে সম্মানিত করার জন্য কালবেলার প্রতি অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কালবেলার সংবাদগুলো ফেসবুক ও ইউটিউবে দেখি। মাঝেমধ্যে পত্রিকায়ও কালবেলা পড়ি। নিরপেক্ষ ও সাহসী ভূমিকা নিয়ে কালবেলা যেভাবে সংবাদ পরিবেশন করছে, তাতে কালবেলা বহুদূর যাবে। আমি কালবেলার সাফল্য কামনা করছি।’
মানসেবায় ব্রত আশরাফুল বলেন, আমার মতো একজন ছোট মানুষকে কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নিয়ে এসে সম্মানিত করার জন্য কালবেলা পরিবারকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
মন্তব্য করুন