‘রানার/ জানা-অজানার বোঝা আজ তার কাঁধে/ বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে’-সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা বিখ্যাত এ কবিতাকে আরও বিখ্যাত করেছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান ‘রানার ছুটেছে’। একসময় শহর-গ্রামের হাজারো মানুষের দুঃখ-কষ্টের গল্প বয়ে নিয়ে যাওয়া রানারদের আজকাল বোঝা বহনের তেমন কাজ নেই।
বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের কাছে প্রায় অপরিচিত একসময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের এই মাধ্যম। আগের স্কুল-কলেজপড়ুয়াদের কাছে ডাকপিয়ন নাম ছিল এক বিস্ময়ের। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যোগাযোগের জন্য চিঠির প্রয়োজন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। মুহূর্তেই টেক্সট, অডিও আর ভিডিও কলের যুগে চিঠির অপেক্ষা এখন অসম্ভব বিষয়।
তাই রানার পেশাটা এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন ডাক বহনের জন্য গাড়ি আছে। আগে রানার হাতে লণ্ঠন আর বল্লম নিয়ে রাতবিরাতে ডাক নিয়ে যেতেন দূর-দূরান্তে। বল্লমের মাথায় বাঁধা থাকত ঘণ্টা, যাতে সেই ঘণ্টাধ্বনি শুনে মানুষ বুঝতে পারে রানার চলেছে। কেউ যেন তাকে দেখে চোর-ডাকাত মনে না করে।
তেমনই এক রানার হচ্ছেন সিলেটের মুজিবুর রহমান। টানা ৩৩ বছর মানুষের বাসাবাড়িতে গিয়ে প্রয়োজনীয় নথি ও চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, মানিঅর্ডার, পার্সেল বিলি করেছেন তিনি। চাকরিক্রম নিম্নপর্যায়ের হওয়ায় কখনো কোনো সম্মান জোটেনি। তাই সেই আক্ষেপ ছিল তার সারা জীবনের।
গত ৯ অক্টোবর ছিল বিশ্ব ডাকঘর দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে জাতীয় দৈনিক কালবেলা সমাজে বিশেষ অবদান রাখায় ডাক বিভাগ থেকে বিশেষ ব্যক্তিদের নির্বাচিত করে সম্মাননা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সিলেট ব্যুরো অফিস থেকে সেই বিশেষ সম্মাননা অর্জন করেন রানার মুজিবুর রহমান।
সিলেট ব্যুরো অফিসে আয়োজিত কালবেলার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মুজিবুর রহমানের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। এ সময় সিলেট ব্যুরো প্রধান মিটু দাস জয়সহ জেলার সব উপজেলার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। কালবেলার সম্মাননা পেয়ে আবেগাপ্লুত মুজিবুর রহমান বলেন, চাকরিজীবনে কর্মদক্ষতা দেখিয়ে ডাক বিভাগ থেকে দুটি অফিসিয়াল সম্মাননা পেলেও, এর বাইরে কেউ কখনো তাদের মতো চাকরিজীবীদের মূল্যায়ন করেনি। জীবনে প্রথমবার কোনো মিডিয়া প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পেয়ে তিনি গর্বিত ও অভিভূত। তাই কালবেলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, কালবেলার পথচলা আরও মসৃণ হোক। সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি কালবেলা সফলতার দিকে এগিয়ে যাক দুর্বার গতিতে, এটাই আমার প্রত্যাশা।
প্রায় ৩৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে সিলেটের প্রধান ডাকঘরের রানার হিসেবে কর্মরত থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অবসরে যান ষাটোর্ধ্ব মুজিবুর রহমান। গল্পচ্ছলে জানিয়েছেন নিজের চাকরিজীবনের নানা সুখ-দুঃখের স্মৃতিময় সময়গুলোর কথা।
মুজিবুর বলেন, সততা, সময়ানুবর্তিতা ও দায়িত্বশীলতা ছিল আমার পেশার মূল শক্তি। সে কারণে মানুষের কাছে নিজেকে আস্থা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছে। একসময় একজন রানার ছিলেন সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীলতার প্রতিমূর্তি। আমাদের দেখলে সবার মনে হতো তারও প্রিয়জনের কোনো খবর আছে আমার কাছে। সবার জীবনের হাসি, কান্না, দুঃখের গল্প বয়ে বেড়িয়েছি।
বর্তমান ডিজিটালাইজেশনের যুগে চিঠিপত্রের কদর কমেছে জানিয়ে মুজিবুর রহমান বলেন, একসময় ডাকঘর ও ডাকঘরের মাধ্যমে চিঠিপত্র, দলিল, মানিঅর্ডার, পার্সেল আদান-প্রদান হতো খুব বেশি। সে সময় প্রতিটি বাসাবাড়িতে রানারদের গুরুত্বও ছিল অনেক। অনেকে চা-পানি আপ্যায়ন করাতেন। কিন্তু এখনকার সময়ে ডাকঘরের প্রয়োজনীয়তা শুধু দাপ্তরিক কাজে সীমাবদ্ধ। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এখন আর চিঠি, মানিঅর্ডার ও পার্সেল আদান-প্রদান হয় না। কারণ এখন সবাই ডিজিটাল।
মন্তব্য করুন