চিকিৎসক সংকট। নেই স্টোরকিপার, সুইপার, ডিজিটাল এক্সরে মেশিন ও পর্যাপ্ত ওষুধ। সরবরাহ নেই ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট, হাম-মিজেলস’র টিকাসহ বেশকয়েকটি টিকা। জেনারেটরের জন্য যে তেল প্রয়োজন সেটারও বরাদ্দ নেই হাসপাতালটিতে।
শুক্রবার (৮ নভেম্বর) সরেজমিনে এমন করুণ দশা চোখে পড়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
চিকিৎসক সংকট
হাসপাতালটিতে মেডিকেল অফিসারের পোস্ট রয়েছে ২৩টি। এরমধ্যে ৯টি খালি। বাকি ১৪টির মধ্যে এক জন চিকিৎসক আছেন সাময়িক বরখাস্ত। দুজন প্রেষণে (লোকাল অর্ডার) রয়েছেন ঝিনাইদহ শিশু হাসপাতালে ও এক জন জেলা সদর হাসপাতালে। ১১ জন কলসালটেন্ট থাকার কথা থাকলেও আছে এক জন। বাকি ১০টি পদ খালি। একজন কার্ডিওলজিস্ট বা হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ থাকলেও এ হাসপাতালটিতে সেবা দেন দুদিন, বাকি ৪ দিন থাকেন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে।
এদিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ গাইনি ও অ্যানেসথেসিয়া পদও খালি রয়েছে দীর্ঘদিন। এতে হাসপাতালটিতে নিয়মিত হচ্ছে না গর্ভবতী নারীদের সিজারিয়ান অপারেশন। ফলে প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষের জন্য ৫০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালটি কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। হাসপাতালটিতে রোগী সবসময় থাকে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ বেশি। একে তো অতিরিক্ত রোগী, তার ওপর চিকিৎসক সংকট। ফলে যেসব চিকিৎসক দায়িত্বে থাকেন তাদের হিমশিম খেতে হয়। চিকিৎসক সংকটের কারণে হাসপাতালের আউটডোর চলে উপসহকারী মেডিকেল অফিসার দিয়ে। ফলে হাসপাতালে যথাযথ সেবা না পেয়ে অনেক রোগী ছোটেন বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে।
পর্যাপ্ত সুইপার নেই
৫০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালটিতে সুইপারের পোস্ট রয়েছে ৫ জনের। তবে আছে ৩ জন। বাকি দুটি পদ খালি। ৩ জনের মধ্যে একজন আবার প্রেষণে (লোকাল অর্ডারে) রয়েছেন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে। পর্যাপ্ত সুইপার না থাকায় যেখানে-সেখানে ময়লার স্তুপের দেখা মিলছে। ওয়ার্ডের মেঝে বারবার পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে রোগীরা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
কিট ও টিকা সংকট
হাসপাতালটির প্যাথলজিতে রয়েছে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট সংকট। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে বাইরে থেকে বেশি দামে কিট কিনে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে র্যাবিশ (জলাতঙ্ক) ভাইরাসের টিকা সংকট। ফলে বিনামূল্যের এমন টিকা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা। হাসপাতালে জলাতঙ্ক টিকা না থাকায় বাধ্য হয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে টিকা কিনে তা গ্রহণ করছেন রোগীরা। এদিকে হাম-রুবেলা ও পোলিং টিকাসহ ৩ ধরনের টিকার সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে।
ওষুধ সংকট
ডায়াবেটিস ও প্রেসারের ওষুধের সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে। ফলে রোগীরা পাচ্ছে না বিনামূল্যের এসব ওষুধ। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে থেকেই কিনতে হচ্ছে তাদের।
জিজিটাল এক্সরে মেশিন নেই ও জেনারেটরের তেলের বরাদ্দ নেই
হাসপাতালটিতে রয়েছে পুরোনো মডেলের একটি এক্সরে মেশিন। তাও কয়েকবছর পড়ে থাকার পর তা চালু করা হয়েছে। রোগীরা বলছেন, এত পুরোনো মেশিন দিয়ে ঠিকমতো এক্সরে করা যায় না। বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। রিপোর্টেও ভুল আসে। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে তিনগুণ টাকা বেশি দিয়ে এক্সরে করাতে হয়। এদিকে লোডশেডিংয়ের সময় বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হাসপাতালটিতে রয়েছে জেনারেটর ব্যবস্থা। তবে জেনারেটরটির তেল বরাদ্দ নেই। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে একপ্রকার অন্ধকারে থাকতে হয়।
দালালের ফাঁদ
শৈলকুপা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘিরে প্রায় ৩০ দালালের সক্রিয় উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫। হাসপাতালের চারপাশের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ফার্মেসি এসব দালালকে পালছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রোগী ভাগানোর ওপর দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে কমিশন ঢোকে দালালের পকেটে। দালালদের ‘প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব’ তৈরি করতে দেওয়া হয় লোভনীয় টাকার প্রস্তাব। যেসব বিভাগে রোগীর আধিক্য, অস্ত্রোপচারের জন্য বেশি টাকার প্রয়োজন হয় সে সব বিভাগে রোগী ভাগাতে সেখানেই থাকে দালালদের চতুর চোখ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সক্রিয় থাকে দালালরা। রোগী ও তাদের স্বজনকে ফাঁদে ফেলতে সক্ষম এমন দালালদের মাঠে দায়িত্ব দেয় নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান। পুরুষ দালালদের পাশাপাশি নারী দালালদের হাতে নিয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
হাসপাতালের প্রধান ফটক ও বিভিন্ন ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করে দালালরা। দালালেরা প্রথমে নিজেদের হাসপাতালের কর্মী পরিচয় দেন। পরে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কথা বলে উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিকে ভাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। হাসপাতালের যন্ত্রাদি অচল ও নিম্নমানের বলে রোগীদের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকে নিয়ে যায়।
স্টোরকিপার ও ফার্মাসিস্ট সংকট
হাসপাতালটিতে ফার্মাসিস্ট আছেন দুজন। এরমধ্যে একজন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে স্টোরকিপারও সংকট রয়েছে।
এতসব সংকট বা সমস্যার বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রাশেদ আল মামুন বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসক, জনবলসহ বেশকিছু সংকট ও সমস্যা রয়েছে। ফলে কাঙ্খিত সেবা নিশ্চিত করতে অসুবিধা হচ্ছে। তবুও সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সেবা দেওয়া সম্ভব তা দেওয়া হচ্ছে। সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদা চেয়ে পাঠানো হয়েছে। খুব দ্রুত সকল সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।
মন্তব্য করুন