অসুস্থ হয়ে হারিয়েছেন চোখের আলো। কিন্তু মনের আলো আর ইচ্ছাশক্তির জোরে কোরআনে হাফেজ হয়েছেন মিরাজ ইসলাম। শ্রবণশক্তির মাধ্যমে পবিত্র কোরআন মুখস্থ করেছেন। এরপর থেকে ১৪ ধরে কোমলমতি শিশুদের নিজেই কোরআন শিক্ষা দিচ্ছেন।
হাফেজ মিরাজুল ইসলামের (৩৪) বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার দাউদখালী ইউনিয়নের দেবত্র গ্রামে। তার বাবা আবুল হোসেন ছিলেন একজন কৃষক। চার ভাইবোনের মধ্যে মিরাজুল তৃতীয়।
১৯৯০ সালে জন্মগ্রহণ করা মিরাজুলের ১৪ বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বর হয়। পরে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করেন। সাত-আট ধরে জ্বর থাকার পর একদিন ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন। তারপর বাঁ চোখেরও দৃষ্টিও চলে যায়। তখন থেকেই পুরোপুরি অন্ধ তিনি। তবু তার বাবা চাইতেন মিরাজুল যেন কোরআনে হাফেজ হন।
স্থানীয়রা জানান, মিরাজ ছোটবেলায় কোথাও কোরআন তিলাওয়াত কোথাও শুনলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে বলতেন তাকে যেন একদিন আল্লাহ কোরআনে হাফেজ বানান।
তারা আরও জানান, মিরাজুল দাউদখালী হাফিজিয়া মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। অসুস্থতার কারণে আর মাদ্রাসায় যেতে পারেননি। কিন্তু প্রবল ইচ্ছাশক্তির কারণে ২০০৮ সালে যশোর দারুল সালাম কমপ্লেক্সে তিন বছর পড়ে ৩০ পারা কোরআন মুখস্থ করেন। সেখানে ২০১১ সালে তিনি হাফেজ খেতাব পান।
২০১৭ সালে চালিতাবুনিয়া ছলেহীয়া হামিদিয়া দীনিয়া ও হাফিজি মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। মাত্র ছয় হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। সরকারিভাবে যে প্রতিবন্ধী ভাতা পেতেন, চার মাস ধরে তাও পান না। খুব কষ্টে জীবনযাপন করেন। তবু সেখানে আট বছর ধরে পড়ান। তিনি শত শত ছাত্রকে কোরআন শিখিয়েছেন। তার হাতে ছয়জন ছাত্র হাফেজ হয়েছে।
হাফেজ মিরাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তিনি বলেন, ছোটবেলায় কোরআন শেখার জন্য বেকুল হয়ে থাকতাম। এখন বাচ্চাদের কোরআন তিলাওয়াত শেখাতে পারছি, এটা আমার কাছে ভাগ্য। আমাদের মাদ্রাসায় শিক্ষক আছেন মোট চারজন। মাদ্রাসায় এখন ৪০ থেকে ৪৫ জনের মতো ছাত্র আছে। এর মধ্যে তিনজন এতিম ও তিনজন হাফেজ রয়েছে।
শিক্ষকের পড়া কেমন লাগছে, জানতে চাইলে মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ আবু সাঈদ কালবেলাকে বলে, আমি এই মাদ্রাসার ছাত্র। স্যার অন্ধ হলেও শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত ভালো একজন শিক্ষক। একদিকে অন্ধ, অন্যদিকে তার দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি খুবই প্রখর ও নির্ভুল।
চালিতাবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা আবদুল শাহেদ আলী কালবেলাকে বলেন, শিক্ষার্থীরা তাকে ‘অন্ধ হুজুর’ হিসেবে চেনে। চোখে না দেখেও ভালো করে বাচ্চাদের কোরআন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন ১৪ বছর ধরে। আমাদের এখানে শেখাচ্ছেন ৮ বছর ধরে।
এ বিষয়ে মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আবুল কালাম কালবেলাকে বলেন, শিক্ষকতার পাশাপাশি তার জীবনযাপনে এই মাদ্রাসার ছাত্ররাই তার চলার পথের সাথি। টয়লেটে যাওয়া, গোসল করা, খাওয়াদাওয়া এমনকি কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রেও ছাত্ররাই তাকে সাহায্য করে থাকে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাকে অনেক শ্রদ্ধা করে।
মন্তব্য করুন