গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী শিল্পকারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় জনজীবন এখন মারাত্মক ঝুঁকিতে। বিভিন্ন অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজের ধুলাবালি আর কলকারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় এখানকার দূষণ বাড়ছেই। দিন যত যাচ্ছে গাজীপুরের বায়ুর মানের অবনতি ততই বেড়ে চলেছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে দূষণের শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে গাজীপুর জেলা। দূষণের অবস্থা এখন রয়েছে ভয়ংকর পর্যায়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় এস এস স্টিল মিল। স্টিল মিলের বিষাক্ত ধোঁয়ায় ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে মানুষ। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা আছেন সবচেয়ে ঝুঁকিতে। এখানে শিল্পকারখানার পাশাপাশি আছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, স্কুল, মসজিদ ও মাদ্রাসা। আশপাশে ঘন কালো ধোঁয়ার কারণে দিনের বেলায়ও চারপাশে রাতের অন্ধকার! সকালের প্রখর সূর্যের আলোতেই ঢাকা পড়ে দৃষ্টিসীমা।
স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানান, এস এস স্টিল মিলের ভয়াবহ দূষণের শিকার এ টঙ্গী শিল্পাঞ্চলের মানুষ। বিষাক্ত ধোঁয়া আর শব্দ নিয়ন্ত্রণে নেই ন্যূনতম পদক্ষেপ। ফলে মাশুল গুনতে হচ্ছে আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদের। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না। এলাকাবাসীর অভিযোগ পরিবেশ অধিদপ্তর দায়সারা কাজ করছে। ঘন কালো ধোঁয়ার কারণে দিনের বেলায়ও রাতের মতো অন্ধকার থাকে। বিশেষ করে সকাল বেলা তো কিছুই দেখা যায় না। মনে হয়, এখনও ভোরোর আলো ফোটেনি। অথচ হাতঘড়িতে দেখলে বোঝা যায় সকাল ১০টা পেরিয়ে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘ধোঁয়া শোধনের কোনো উদ্যোগই নেই। এখানকার চুল্লিতে জ্বলে পুরনো লোহার টুকরো। নির্গমন চিমনির উচ্চতা এখানে কম, তাই ধোঁয়ায় ছাদ ও দেয়ালের টিনের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সহজেই। সেই ধোঁয়ায় কালোর আস্তরণ আশপাশের দেয়ালে দেয়ালে। বাতাসে উড়ে ছাই এসে পড়ছে গাছপালা আর আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনায়। কিন্ত দেখার কেউ নেই।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এস এস স্টিল মিলের যন্ত্রাংশ জং বা মরিচা ধরা, ঝুলে থাকা টিন দিয়ে ঘেরা। উচ্চ শব্দে চলছে কারখানাটি। ধোঁয়া নির্গমনের চিমনি থাকলেও চারপাশ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কোন অগ্নিকাণ্ড ছাড়াই ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়ছে আকাশে। এসএস স্টিল মিল থেকে নির্গত ধোঁয়ার কারণে পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে আছে। কারখানার বাঁ-পাশে বস্তির প্রবেশমুখে একটি কাঁচাবাজার।
সেখানকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মিলের চুল্লিতে লোহার টুকরো গলার কারণে সব সময় ধোঁয়া উড়ে। তবে দিনের যেকোনো সময় পুরোনো লোহা পোড়ানোর ফলে আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়, যা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে, এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। সেই কারখানার নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ায় দিনেই নামে রাত। তাদের অভিযোগ দিনের পর দিন ধোঁয়া বের হলেও শোধনের নেই কোনো উদ্যোগ। নির্গমন চিমনির উচ্চতা এখানে কম, তাই ধোঁয়া ছাদ ও দেয়ালের টিনের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সহজেই। বাতাসে উড়ে ছাই এসে পড়ছে গাছপালা আর আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনায়।
দূষণের শিকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, কালো ধোঁয়ার কারণে শ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়েছে। অনেকেই আক্রান্ত শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগবালাইয়ে। এস এস স্টিল মিলে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কারখানার শব্দদূষণের শিকার তারাও। শুধু ধোঁয়া কিংবা শব্দ নয়, এস এস স্টিল মিলের ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামোয় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এ নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। দশ মাস অতিবাহিত হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের এস এস স্টিল কোম্পানিকে তাদের লাইসেন্স নবায়ন বাতিল করেছে। এদিকে প্রশাসনকে বিদ্যা আঙুল দেখিয়ে এ স্টিল কোম্পানি তাদের কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিক্রেতা আবদুল মতিন জানান, ধোঁয়ায় আকাশ দেখা যায় না। ১০ হাত দূরেও কিছু দেখা যায় না। অনেক কষ্টে আছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
হামিম গ্রুপের এক গামের্ন্টস কর্মী শেফালী আক্তার বলেন, ‘এই ধোঁয়ার কারণে আমরা ঠিকমতো কাপড় শুকাতে পারি না। ধোঁয়ার কারণে সব কালো হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে কাপড় শুকাতে দিলেও কাপড়ে কালো আস্তর পড়ে থাকে। আমরা খুব বিপদে আছি। এখানে ঘরে, ঘরে সর্দিকাশি ও শ্বাসকষ্ট লেগেই আছে।’
টঙ্গী পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপাল আলাউদ্দিন মিয়া, বলেন, ‘এসএস স্টিল শুধু যে বায়ুদূষণ করছে তা নয়, পানি দূষিত হচ্ছে। এখানকার উত্তপ্ত পানি বিভিন্ন নালা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। যার ফলে আশপাশের নালার মাছ ও কৃষি জমি নষ্ট হয়ে যায়ে। এ কারণে মানুষের ভোগান্তি হয়।’
এস এস স্টিল মিলসের সিনিয়র ম্যানেজার মো. রাসেল কালবেলাকে বলেন, কোম্পানির নবায়ন বাতিল হয়েছে, এটি সঠিক, তবে তা নবায়ন করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য কাগজ দেখানো যায়নি, এটা মোটেও সত্য নয়।
এ বিষয়ে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আরেফিন বাদল কালবেলাকে বলেন, বিষয়টি শুনেছি ও অবগত আছি।
পুরো এলাকা অন্ধকার হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এস এ সিস্টেম মিলস হাইকোর্টে একটি রিট করেছে, ওই রিটের বিপরীতে পরিবেশের আইনজীবী কাজ করছেন। এটার ২০২২ সালের ডিসেম্বরে হাল নাগাদ নবায়ন আছে। এখানে বায়ুরমান লিমিট ২০০ এসপিএম কিন্তু ওনাদের আছে ৩১৬ এসপিএম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশি খারাপ না। যদি ১০০ বা ৫০০ হতো তাহলে খারাপ ছিল। রাস্তায় যে কন্সট্রাকশনের ধুলাবালি সেখানেই ৪০০ পাওয়া যায়।
মন্তব্য করুন