বরিশাল ব্যুরো
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ঝালকাঠির উন্নয়ন মানেই আমুর কমিশন বাণিজ্য

আমির হোসেন আমু। পুরোনো ছবি
আমির হোসেন আমু। পুরোনো ছবি

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও মুখপাত্র বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু। জাতীয় নেতা হলেও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি সবচেয়ে বেশি ছিল ঝালকাঠিতে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল জেলায়, যারা আমুর হয়ে জেলার সব ধরনের ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ। এই চক্রের মাধ্যমে আমু হয়ে উঠেছিলেন ঝালকাঠির গডফাদার।

জানা যায়, ঝালকাঠিতে উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ মানেই আমুকে কমিশন দিতে হতো। এ কাজে নিজের একটি বাহিনী তৈরি করেছিলেন তিনি। আমুর হয়ে বেশির ভাগ কাজ করতেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন খান সুরুজ ওরফে রাঙ্গা ভাই, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আল মাহমুদ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রেজাউল করিম জাকির ওরফে জিএস জাকির এবং জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল শরীফ।

স্থানীয়ভাবে তারা ‘চার খলিফা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমুর ভায়রা ও এপিএস ফখরুল মজিদ কিরণ, ঢাকার বাসার আমুর ব্যক্তিগত সহকারী শাওন খানকেও কিছু ভাগ দিতে হতো। আমুর নামে তারা ৩০-৪০ শতাংশ কমিশন নিয়ে সাধারণ ঠিকাদারদের কাছে দরপত্র বিক্রি করে দিতেন।

এলজিইডির সূত্রে জানা গেছে, ‘চার খলিফা’র নেতৃত্বে ঢাকার এলজিইডি ও সওজ অধিদপ্তরসহ মন্ত্রণালয় থেকে অপ্রয়োজনীয় কালভার্ট ও সেতুর প্রকল্প তৈরি করে নিয়ে আসা হতো। অনেক সময় ভালো সেতু ভেঙেও নতুন সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ আনা হতো। আমুর ডিও লেটারের মাধ্যমে নেওয়া এসব কাজে অতিরিক্ত বরাদ্দ ধরা থাকত। পরে এসব কাজ প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশনে বিক্রি করে দেওয়া হলেও ঠিকাদারের লাভ থাকত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঝালকাঠি সড়ক ও জনপথের (সওজ) এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঠিকাদার নির্বাচনে আমুর সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। ই-টেন্ডার চালু হওয়ার পর দরপত্র (গুচ্ছ) নেওয়া গেলেও জমা দিতে দরপত্রের কাগজ তুলে দিতে হতো ‘চার খলিফা’র হাতে। কথা না শুনলে সরকারি কর্মকর্তাদের কেবল বদলি নয়, হেনস্তা করা হতো। সড়ক বিভাগের মতো এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তর, গণপূর্ত, জেলার চার উপজেলা প্রকৌশলী, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের প্রকল্প বাস্তবায়ন বিভাগসহ সব ক্ষেত্রেই ছিল একই নিয়ম।’

জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মনিরুল ইসলাম তালুকদার ওরফে মনির হুজুর ছিলেন আমুর বিশ্বস্ত সহচর। মনিরুলের বাবা লিয়াকত আলী তালুকদার ছিলেন পৌরসভার মেয়র। পৌরসভার সব ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন মনিরুল। তিনি প্রতিটি ঠিকাদারি কাজ শুরু করার আগেই আমুর কমিশনের ভাগ হিসাব করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতেন। তার পরিবার কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে।

ঝালকাঠি এলজিইডির ঠিকাদার মেসার্স মনোয়ারা এন্টারপ্রাইজের মালিক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে এলজিইডিতে কাজ করছি। লটারির মাধ্যমে কয়েকটি কাজ পেয়েও আমুকে ৫ পার্সেন্ট হারে কমিশন দিতে হতো। টাকা না দিলে কাজ করা সম্ভব হতো না। আমার কাছ থেকে ৬৮ লাখ ও ৩৩ লাখ টাকার দুটি কাজের বিপরীতে প্রায় ৪ লাখ টাকা কমিশন নেওয়া হয়েছে।’

ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সদস্যসচিব শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘গত ১৬ বছর সব সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকে কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন আমির হোসেন আমু। নৈশপ্রহরী থেকে শুরু করে সব চাকরিতে আমুকে টাকা দিতে হতো। বিএনপির নেতাকর্মীরা বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি।’

এরইমধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেনকে (আমুকে) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার (৬ নভেম্বর) বেলা দেড়টার দিকে পশ্চিম ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আমির হোসের আমুর গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি বলেন, আমির হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। তিনি ১৪ দলের সমন্বয়ক ছিলেন।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এরপর আমুর ঝালকাঠির বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে ওই বাড়ি থেকে পোড়া-অক্ষত মিলিয়ে প্রায় চার কোটি টাকা ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এর আগেই আমু পালিয়ে যান। এর পর থেকে ওনার অবস্থান সম্পর্কে জানে না কেউ। বর্ষীয়ান এ নেতার নামে একাধিক মামলা হয়েছে। গত ১৮ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশনায় তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া আমুর পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনও স্থগিত করা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ (মালেক) থেকে। এর পরের যত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল, সব কটিতেই দলের প্রার্থী ছিলেন তিনি। ২০০০ সালের উপনির্বাচনে ঝালকাঠি-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালে দায়িত্ব পান শিল্পমন্ত্রীর। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঝালকাঠি-২ (সদর-নলছিটি) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হন আমু।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইসি গঠনে পাঁচ নাম প্রস্তাব বিএনপির

বেরোবিতে ছাত্রদলের রাজনৈতিক পোস্টার, জানেন না প্রক্টর

সিলেটে বিপুল চিনি নিয়ে ৩ চোরাকারবারি ধরা

ঐক্যবদ্ধভাবে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে হবে : রাশেদ প্রধান 

নেইমারকে নিয়ে ধৈর্য হারাচ্ছে আল-হিলাল

পবিপ্রবিতে ইডিইজির ডিজিটাল স্কিল ট্রেইনিং কার্যক্রমের অ্যাক্টিভেশন প্রোগ্রাম

ট্রাম্পকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে : প্রেস সচিব

মহাসম্মেলনে জনদুর্ভোগ, ওলামা মাশায়েখের দুঃখ প্রকাশ

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ঢাকায় ছাত্রদলের পোস্টারিং

চীনের সিআইআইই মেলায় অংশ নিয়েছে ওয়ালটন

১০

পেঁয়াজ আমদানির শুল্ক প্রত্যাহার

১১

ট্রাম্পের জয়ে পুতিনের নতুন বার্তা

১২

আমুকে ‘লবণ চোর’ মানলেই লবণ উপহার

১৩

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নড়াইল জেলা আহ্বায়ক কমিটি

১৪

মহাসম্মেলন সফল করায় ওলামা মাশায়েখের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

১৫

রেল নিয়ে মাহবুব কবির মিলনের চ্যালেঞ্জ

১৬

বগুড়ায় ছাত্র হত্যাচেষ্টা / সাংবাদিকসহ আ.লীগের ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা

১৭

অবশেষে নাসুম-নাহিদের ভিসা সমস্যার সমাধান

১৮

আরও ৯ পুলিশ কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক অবসরে

১৯

ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে জাতীয় কমিটি গঠন

২০
X