স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাউকে ব্যবসার অংশীদার করার আশ্বাস দিয়ে আবার কাউকে মূলধনের মাসিক লাভ দেবেন বলে প্রলোভন দেখিয়েছেন যুবক অনিন্দ্য রায়। একসময় তার মিষ্টি কথায় ব্যবসায়ীরা রাজি হয়ে যান। তখন উভয় পক্ষ লিখিত স্ট্যাম্প করে এবং ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাংক চেক দিয়ে টাকা গ্রহণ করেন অনিন্দ্য। এভাবে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি।
এভাবে কোটি টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার জগদীশপুর ইউনিয়নের জগদীশপুর গ্রামের অনিন্দ্য রায়ের (৩০) বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, টাকা ফেরত চাইলে অনিন্দ্য রায় নিজেকে কখনো বিএনপি নেতা, কখনো ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে তাদের ভয়ভীতি দেখান। তার প্রতারণার শিকার এলাকার ২০ থেকে ৩০ জন ব্যবসায়ীর পরিবারে নেমে এসেছে হতাশা। অনেকে পথে বসেছেন।
তবে খোঁজ নিলে স্থানীয়রা জানান, বাস্তবে কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে অনিন্দ্যর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তার প্রতারণার শিকার হয়ে ভুক্তভোগী এক ব্যবসায়ী এখন ঘোষণা দিয়েছেন যে টাকা ফেরত না পেলে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেবেন।
সরেজমিনে জানা যায়, অভিযুক্ত অনিন্দ্য রায় স্থানীয় শ্যামপুর গ্রামের ব্যবসায়ী বিমল শীলের কাছ থেকে ৫১ লাখ টাকা, জগদীশপুর গ্রামের দেলোয়ার হোসেন শানিলের কাছে থেকে ১০ লাখ, জগদীশপুর গ্রামের মহিতুষ রায়ের কাছ থেকে ১১ লাখ, জগদীশপুর গ্রামের মলয় সূত্রধরের কাছ থেকে ৯ লাখ, জগদীশপুর গ্রামের বাবুল রায়ের কাছ থেকে ৪ লাখ, বেজুরা গ্রামের নুরে আলমের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছেন। প্রত্যেকের সঙ্গে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখিত স্ট্যাম্প করেছেন অনিন্দ্য। এ ছাড়া সবাইকে তিনি সিটি ব্যাংকের চেকও দিয়েছেন অনিন্দ্য। যা এই প্রতিবেদকের হাতে সংরক্ষিত আছে।
এসব প্রতারণা ছাড়াও আরও ১০ থেকে ১৫ জনের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে যুবকের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা এ বিষয়ে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে অনিন্দ্য ও তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, প্রতারণায় অভিযুক্ত যুবক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করে গড়ে তুলেছে সাম্রাজ্য। কিনেছেন চারটি বিলাসবহুল গাড়ি। বিনিয়োগ করেছেন স্থানীয় নোয়াহাটি তাদের পারিবারিক বয়লার ব্যবসায়। মাধবপুর পৌরসভায় বানিয়েছেন তিনতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। নামে-বেনামে বিভিন্ন জায়গায় খরিদ করেছেন জমি।চড়া সুদে বিভিন্ন লোকের কাছে লগ্নিও করেছেন বিপুল পরিমাণ টাকা। অনিন্দ্যের বেপরোয়া ও বিলাসিতার নমুনা তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বিভিন্ন ছবি ও পোস্টেও দেখা গেছে।
ভুক্তভোগী সেলুন ব্যবসায়ী বিমল শীল কালবেলাকে বলেন, ‘আমি জমি বিক্রি করার ৫১ লাখ টাকা ব্যবসায় পার্টনার করবে বলায় স্ট্যাম্প করে অনিন্দ্যকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সে টাকা দেবে তো দূরে থাক, এখন সে পলাতক। সে নিজেকে ছাত্র সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে আমাদের ভয় দেখায়। আমি ও আমার পরিবার আজ পথে বসে গেলাম। আমরা তার বিচার চাই।’
আরেক ভুক্তভোগী নূরে আলম বলেন, ‘আমি ধারকর্জ করে তাকে টাকা দিয়েছিলাম। এখন ওই সব পাওনাদার আমার বাড়ি ছাড়ছে না টাকার জন্য। আমি খুব পেরেশানির মধ্যে রয়েছি। সম্প্রতি দেলোয়ার নামে এক ভুক্তভোগী টাকা চাইতে দিলীপ ও অনিন্দ্যের বাড়িতে গেলে টাকা না পেয়ে উল্টো হামলার শিকার হয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে অভিযুক্ত অনিন্দ্য রায়ের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে বক্তব্যের জন্য তার বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেননি।
ছেলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে এবং এর পক্ষে প্রমাণপত্র আছে জানালে অনিন্দ্য রায়ের বাবা দিলীপ কুমার কালবেলাকে বলেন, ‘মানুষ তো আমাকে বলে টাকা ধার দেয়নি। আমি বিষয়টি এখন জানলাম। দেখি কিছু করা যায় কি না।’
সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে স্থানীয় জগদীশপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘একজন ভুক্তভোগী এ বিষয়ে আমার কাছে অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি সত্য হলে তা অনেক বড় প্রতারণা। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করব।’
মাধবপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমানতের নামে এত বিপুল পরিমাণ টাকা যুবকের সংগ্রহ করা আইনসম্মত হয়নি। এনজিও সংক্রান্ত মাসিক মিটিংয়ে আমরা এ নিয়ে আলোচনা করব। কেউ অভিযোগ করলে এটি সমাধানের চেষ্টা করব।’
যুবককে দুদকের আওতায় আনার কথা জানিয়ে হবিগঞ্জ দুদকের উপপরিচালক মোজাম্মেল হক কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা মানিলন্ডারিং আইনে অপরাধ। যুবকের প্রতারণা তদন্তে প্রমাণিত হলে আমরা এ বিষয়ে মামলা দিতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেব।’
যোগাযোগ করা হলে মাধবপুর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘যুবকের প্রতারণার বিষয়টি আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।’
মন্তব্য করুন