রাতে ডিউটি শেষে ভোরে কারখানা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই যুবককে ধরে বাঁধা হয় গাছের সঙ্গে। চুরির অভিযোগ তুলে দিনভর রড, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে পেটানো হয় তাদের। এরপর চোখে-মুখে ও সারা শরীরে লবণ ও মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
গত মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার আবদার গ্রামে অটোরিকশা চুরির অপবাদ দিয়ে দিনব্যাপী মধ্যযুগীয় কায়দায় দুই যুবককে এমন নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ওই দুই যুবক মারধরের আশঙ্কায় পুলিশের সহযোগিতা নিতে পারছেন না।
নির্যাতনের শিকার যুবক মো. আলমগীর হোসেন (২৪) শ্রীপুর উপজেলার আবদার গ্রামের আছিম উদ্দিনের ছেলে। শিশু বয়সে মা-বাবা হারানো আলমগীর মামার বাড়িতে বসবাস করেন। অপর যুবক মাইনুদ্দিন সোহেল (২৬) ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার ভাতাদিয়া গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে। তারা দুজনই উপজেলার সাইটালিয়া গ্রামের ইরেক্টস্ পুলস এন্ড স্টাকচারস্ লিমিটেডের শ্রমিক।
অভিযুক্ত ফাইজুদ্দিন, তার স্ত্রী লিমা আবদার গ্রামের বাসিন্দা। তাদের ওপর নির্যাতনে আরও কয়েকজন অংশ নেন বলে জানা গেছে।
নির্যাতনের শিকার দুই যুবক ও তাদের স্বজনরা জানান, গত শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) ফাইজুদ্দিনের মালিকানাধীন অটোরিকশা চালককে নেশা জাতীয় খাবার খাইয়ে অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ফাইজুদ্দিন ও তার চালক মঙ্গলবার ভোরে কারখানার সামনে থেকে চুরির অভিযোগে আলমগীর ও সোহেলকে আটক করে আবদার গ্রামে বাড়ির কাছে নিয়ে আসে। সকাল ৭টায় তাদের দুজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে চালানো হয় নির্যাতন। তাদের রড, বাঁশ, কাঠ দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। বিকেল ৩টা পর্যন্ত নির্মম নির্যাতন করা হয়। এতে তাদের হাত, পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত ও ক্ষত হয়। মারধরের এক পর্যায়ে ফাইজুদ্দিনের স্ত্রী লিমা ওই দুই যুবকের চোখে-মুখে মরিচের গুড়া ও লবণ ছিটিয়ে দেন। ক্ষত স্থানেও দেওয়া হয় মরিচের গুড়া ও লবণ লাগানো হয়।
অটোরিকশার মালিক ফাইজুদ্দিন বলেন, গত শুক্রবার দুই যুবক আমার একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে কাওরাইদ, বরমী ও শ্রীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করে। এক পর্যায়ে স্যালাইনে নেশা জাতীয় কোনো দ্রব্য খাইয়ে চালকের কাছ থেকে অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমি ওই অটোরিকশা উদ্ধারে চালককে নিয়ে বিভিন্ন জায়গাতে যাই। এক পর্যায়ে চালকই ওই দুজনকে শনাক্ত করে। পরে তাদের ধরে এনে এলাকার শত শত মানুষ মারধর করেছে। আমার কিছুই করার ছিল না।
তাদের না পিটিয়ে পুলিশে কেন দিলেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে তার স্ত্রী লিমা বলেন, চোরের শাস্তি পেটানো। দেখেন না কোথাও চোর ধরলে গণপিটুনি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে। আমরা তো পিটিয়েছি মাত্র।
আহত আলমগীর বলেন, আমি সোমবার রাতে কারখানায় ডিউটি করেছি। সকালে কারখানা থেকে বের হতেই তারা আমাকে আটক করে গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে হাত পা বেঁধে অনেক মারধর করেছে। আমাকে খুব পেটানো হয়েছে, আমি তাদের বারবার বলেছি, আমি অটোরিকশা চুরির বিষয়ে কিছুই জানি না। তারা আমার কথা না শুনে তবুও পিটিয়েছে। এক পর্যায়ে আমার চোখ-মুখ ও শরীরের ক্ষত স্থানে মরিচের গুঁড়া ও লবণ ছিটিয়েছে।
থানা পুলিশের সহযোগিতা কেন চাননি, এমন প্রশ্নের জবাবে আলমগীর বলেন, তারা এলাকায় খুব প্রভাবশালী। অন্যায়ভাবে আমাদের পেটালেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তাদের ভয়ে কেউ কথা বলতে পারছে না। এখন থানায় গেলে আবার মারধর করতে পারে। এমন শঙ্কায় আমরা থানায় যেতে ভয় পাচ্ছি।
নির্যাতনের শিকার অপর যুবক মাইনুদ্দিন সোহেল বলেন, আমাকে অন্যায়ভাবে শুধু সন্দেহের বশে এভাবে পেটানো হয়েছে। ঘটনার দিন আমি কারখানার ভেতরে ছিলাম। আমাকে এত নির্যাতন করছে, আমি বারবার বলেছি, আমি চুরির বিষয়ে কিছুই জানি না। কিন্তু আমার কথা কেউ শোনেননি। পিটিয়েই তারা ক্ষান্ত হননি, আমার ভাইয়ের কাছ থেকে তারা ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
স্থানীয় মজিবুর রহমান বলেন, শুধু সন্দেহের বশে এমনভাবে তাদের পেটানো, চোখে-মুখে ও ক্ষতস্থানে মরিচের গুঁড়া দেওয়া ঠিক হয়নি। আমরা বারবার না করলেও আমাদের কথা শোনেননি। তারা যদি কোনো অন্যায় করেই থাকে তাহলে তাদের পুলিশে দিতে পারত।
শ্রীপুর মডেল থানার ওসি জয়নাল আবেদীন মন্ডল বলেন, এ ঘটনায় এখনো কেউ থানায় আসেননি। লিখিত বা মৌখিক অভিযোগও জমা দেননি। নিজ থেকে উদ্যোগ নিয়ে নির্যাতনের শিকার যুবককে সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন