কথা হয় ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাজীরবেড় গ্রামের আতিয়ার রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, তিন সপ্তাহ ধরে মহেশপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুরেও রেজিস্ট্রি করাতে পারেননি তার জমির দলিল। কোটচাঁদপুর থেকে সাব-রেজিস্ট্রার মাঝেমধ্যে এলেও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না তার। হচ্ছে না সময়ের সমন্বয়। এতে একদিকে যেমন তাকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, অন্যদিকে খরচের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে।
আতিয়ার জানান, তাদের মহেশপুর উপজেলার জন্য যদি নির্দিষ্ট একজন সাব-রেজিস্ট্রার থাকতেন তাহলে রেজিস্ট্রির চাপ কমত। এতে অফিস চলাকালে অনেকে যে কোনো দিন রেজিস্ট্রির কাজ সারতে পারত।
অন্যদিকে দলিল লেখক হারুন-অর-রশিদ বলেন, জেলার শূন্য পদগুলোতে স্থায়ী সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় দলিল রেজিস্ট্রি করতে সাধারণ দলিল লেখকদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। প্রভাবশালী লেখকদের দলিল সাহেব (সাব-রেজিস্ট্রার) আসলে সেদিনই রেজিস্ট্রি হয়ে গেলেও, সাধারণ অনেক লেখকের দলিল কয়েক সপ্তাহ পড়ে থাকছে সাব-রেজিস্ট্রারের টেবিলে। এ অবস্থায় সাধারণ লেখকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। অনেকটা মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে তাদের। এ কারণে এলাকাবাসীর ভোগান্তি কমাতে শূন্য পদে সাব-রেজিস্ট্রার নিয়োগ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন জেলার ৬টি উপজেলার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ উপজেলায় সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিন উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রাররা বাকি উপজেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গড়ে সব অফিসগুলোতে বেসামাল অবস্থা দাঁড়িয়েছে। গত ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনে দলিল লেখক সমিতির প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমলেও সাব-রেজিস্ট্রার সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে জেলার ৬টি উপজেলায় মোট সাব-রেজিস্ট্রারের সংখ্যা অর্ধেক, অর্থাৎ তিনজন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় সিনিয়র একজন সাব-রেজিস্ট্রার থাকলেও, বাকি দুজন পাঁচ মাস আগে গত ২৬ মে নতুন নিয়োগ পেয়ে প্রথম কর্মস্থল হিসেবে জেলার কোটচাঁদপুরে শূন্য পদে (তামীম আহম্মেদ চৌধুরী) ও শৈলকুপায় (সোনালী খানম) সাবেক সাব-রেজিস্ট্রারের বদলিজনিত শূন্যপদে যোগদান করেন।
এ দুজন নতুন কর্মকর্তা যোগদান করেই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন। নতুন চাকরি হিসেবে যেখানে নিজ কর্মস্থল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব তাদের কাছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেমনি ঝিনাইদহ সদরে দায়িত্বরত সিনিয়র সাব-রেজিস্ট্রার সুমন ঘোষ ঝিনাইদহ সদরের মতো বিশাল এলাকার দায়িত্ব শেষে অন্য উপজেলায় সময় দিতে পারছেন না। ফলে যেসব উপজেলায় সাব-রেজিস্ট্রার নেই, সেসব উপজেলার ক্রেতা-বিক্রেতারা সঠিক সময়ে জমি রেজিস্ট্রি করতে না পেরে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন।
অন্যদিকে চাহিদানুযায়ী জমি রেজিস্ট্রি না হওয়ায় সরকার বড় পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। সব উপজেলায় সাব-রেজিস্ট্রার থাকতে আগে যেখানে প্রতিমাসে ন্যূনতম ৫ হাজার দলিল রেজিস্ট্রি হতো, এখন সেখানে রেজিস্ট্রি হচ্ছে দুই হাজার। ফলে সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় জনভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সেইসঙ্গে সরকারের এ খাত থেকে রাজস্ব কমেছে মাসে প্রায় দুই কোটি টাকা।
তথ্য নিয়ে জানা যায়, জেলার মহেশপুর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার বদলি হয়েছেন গত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। তারপর থেকে পার্শ্ববর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গা সদর ও পরে হরিণাকুণ্ডু ও বর্তমানে কোটচাঁদপুরের সাব-রেজিস্ট্রার ওই দপ্তরে সপ্তাহে দুদিন বা একদিন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন।
অন্যদিকে কালীগঞ্জ উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার বদলি হয়েছেন চলতি বছরের ৩ মার্চ। এরপর থেকে ওই উপজেলায় পদটি শূন্য। ঘাটতি মেটাতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার কাউসার আলীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয় চলতি বছরের জুন মাসের ২৩ তারিখে। বিভিন্ন কারণে তিনি গত ৫ মাসে কালীগঞ্জে অফিস করেছেন মাত্র ১১ দিন। হরিণাকুণ্ডু উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার বদলি হয়েছেন গত ১৪ মে। তারপর থেকে সেখানকার পদ খালি। অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শৈলকুপায় নতুন সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সোনালী খানমকে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে তিনি গত ৫ আগস্টের পর হরিণাকুণ্ডুতে মাত্র তিন দিন অফিস করেছেন বলে জানিয়েছেন দলিল লেখকরা। রেজিস্ট্রি করেছেন মাত্র একদিন।
এ ছাড়া কোটচাঁদপুর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর বদলি হওয়ার পর প্রায় ৭ মাস পর সেখানে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার তামীম আহম্মেদ চৌধুরী। তিনি চাকরির প্রথম কর্মস্থলে যোগদান করেই মহেশপুরের মতো বড় একটি উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন।
এসব উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রাররা বদলি হওয়ায় বিভিন্ন গ্রামের মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূর থেকে গিয়ে সময়মতো রেজিস্ট্রারদের না পেয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের। ৫ থেকে ১০ মাস ধরে উপজেলাগুলোয় সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় জেলার জমি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় চলছে গোঁজামিল দিয়ে। তিন সাব-রেজিস্ট্রারকে পালাক্রমে ছয় উপজেলার দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। ফলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীরা। রেজিস্ট্রি না হওয়ায় শত শত জমি ক্রেতা-বিক্রেতা ও জরুরি কাজে দলিল উত্তোলনকারীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন।
দলিল লেখক ও রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীরা জানান, দলিল লেখক সমিতির সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য বন্ধ হলেও কিছু প্রভাবশালী লেখক দলিল প্রতি দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত আদায় করছেন। তাদের আরও অভিযোগ কেউ কেউ সাব-রেজিস্ট্রারের নামেও টাকা নিচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা রেজিস্ট্রার সাব্বির আহম্মেদ কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলো সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তবে জেলার শূন্য পদগুলোতে সাব-রেজিস্ট্রার নিয়োগের জন্য রেজিস্ট্রি অধিদপ্তরে বারবার চিঠি পাঠানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে দুজন নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আশা করি, হয়তো দ্রুত এর সমাধান হবে।
মন্তব্য করুন