একসময়ের বিখ্যাত কার্টুনিস্ট এ কে এম ফিরোজ (৬৫)। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত ফিরোজ নব্বইয়ের দশকে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ধারাবাহিকভাবে কার্টুন এঁকেছেন। শিশুদের জন্য লিখেছেন মজার মজার গল্প-কবিতা। প্রায় দেড়যুগ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের পাতায় কার্টুনিস্ট ফিরোজের কার্টুনেই ছিল ভরপুর।
একসময় গ্রামীণ ব্যাংকেও বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা, মনোগ্রাম তৈরি, অনুষ্ঠানের সাজসজ্জাসহ যাবতীয় শিল্পবিষয়ক কাজ করেছেন তিনি। সেখানে কাজ করার সুবাদে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ফিরোজের ছিল বেশ জানাশোনা। কিন্তু পত্রিকার পাতায় এখন আর আঁকছেন না কার্টুন।
তবে বৃদ্ধ বয়সেও তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শিশুদের চিত্রাঙ্কন ও সুন্দর হাতের লেখা শেখানোর কাজ করেন। সেখান থেকে যে সামান্য টাকা উপার্জন করেন তা দিয়েই চলছিল ফিরোজের তিন সদস্যের সংসার।
কিন্তু হঠাৎই কার্টুনিস্ট ফিরোজের জীবনের ছন্দপতন হয়। প্রথমে স্ত্রী অসুস্থ, এরপর নিজে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবন সায়াহ্নে থমকে যান বিখ্যাত এ কার্টুনিস্ট। অর্থের অভাবে ঠিকমতো চালিয়ে যেতে পারছেন না নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসা।
রোববার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে কার্টুনিস্ট ফিরোজের রাজশাহী নগরীর ভাড়া বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কালবেলার কথা হয়। অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার অনুরোধও জানান তিনি।
একেএম ফিরোজ কালবেলাকে বলেন, কার্টুন আঁকার শুরুটা ১৯৯৪ সাল। গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন বিষয় অবলোকন করে আমি কার্টুন আঁকা শুরু করি। এরপর এটি নেশায় পরিণত হয়। দেশের জাতীয় দৈনিকগুলো আমার আঁকা কার্টুন ছাপানো শুরু করল। এভাবেই প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় কার্টুন আঁকি।
তিনি জানান, অনেকবার দেশে ও বিদেশে তার যৌথ কার্টুন প্রদর্শনী হয়েছে। লিখেছেন ২০টির বেশি শিশুতোষ বই। এখন রাজশাহী নগরীর একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। সেখানে শিশুদের সুন্দর হাতের লেখা ও ছবি আঁকা শিখিয়ে কোনোমতে সংসার চালান তিনি। এরই মধ্যে তার শরীরে বাসা বেঁধেছে কিছু জটিল রোগ। কিন্তু অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তার একমাত্র সন্তান সিয়াম ফিরোজ শহরের নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ছেলের পড়াশোনার জন্যই প্রায় আট বছর আগে ঢাকা ছেড়ে রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি।
কার্টুনিস্ট ফিরোজের বাসায় গিয়ে দেখা গেল, বাসার ডাইনিং স্পেসে চেয়ার-টেবিল পাতা। সেখানে শিশুদের ছবি আঁকার ক্লাস হয়। বাসার অদূরেই একটি কোচিং সেন্টারের মধ্যে করেছেন শিশুদের চিত্রাঙ্কন ও হাতের লেখা সুন্দর করার আরেকটি ক্লাসরুম। দুটি ক্লাসরুম মিলে মাসে প্রায় ১৫ হাজার টাকা বাসাভাড়া গুনতে হয় তাকে। তার আয়ের একমাত্র উৎস শিশুদের চিত্রাঙ্কন ও সুন্দর হাতের লেখা শেখানো। করোনার পর থেকে সেই আয়ও কমে এসেছে। আগের মতো আর শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না বলেও হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
একেএম ফিরোজের উল্লেখযোগ্য কার্টুন সিরিজ ‘কেমন জব্দ’, ‘ভীমবাহাদুর’, ‘মাছি’, ‘গোবরা’ ইত্যাদি। শিশু-কিশোরদের কাছে এসব খুবই প্রিয় ছিল। এখন সেসব শুধুই স্মৃতি। বাঁধাই করা কার্টুনের বইগুলো বুকের কাছে নিয়ে ঘুমান তিনি। এমন দুরবস্থার মধ্যে শরীরের বাসা বেঁধেছে জটিল সব রোগব্যাধি। তার পায়ুপথে ৪টি ও পাকস্থলিতে দুটি টিউমারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দেখা দিয়েছে তার কিডনিতেও সমস্যা।
চিকিৎসক বলেছেন, একেএম ফিরোজের দ্রুত অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। না হলে ক্যানসারের ঝুঁকি আছে। স্ত্রী শিউলি আরা ১০ বছর থেকে চোখের সমস্যায় ভুগছেন। আপনা-আপনি চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য ৩ মাস পর পর ভারতে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ভারতে তিন মাস পর পর ৫০ হাজার টাকার দামি ইনজেকশন দিতে হয়েছে। পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ার পর ২০১৯ সাল থেকে স্ত্রীর চিকিৎসাও রয়েছে বন্ধ।
কার্টুনিস্ট ফিরোজ জানান, তিনি ১৭ বছর গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা, মনোগ্রাম তৈরি, অনুষ্ঠানের সাজসজ্জাসহ যাবতীয় শিল্পবিষয়ক কাজ করেছেন তিনি। এই সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের স্বপ্নদ্রষ্টা ও বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার একটা সখ্যতা ছিল। তার বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামীণ ব্যাংকে কর্মরত থাকায় অবস্থায় ড. ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন সময় তোলা ছবি তিনি স্মৃতি হিসেবে রুমের দেয়ালে দেয়ালে টানিয়ে রেখেছেন।
গত ২০০০ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন তিনি। এখন রাজশাহীতে আর্থিক সংকটের মধ্যে রোগব্যাধির সঙ্গে লড়াই করেছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, তার জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য এ মুহূর্তে অর্থের প্রয়োজন। সেটিও তার পক্ষে জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমন অর্থনৈতিক সংকটে ভক্ত কিংবা সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন কার্টুনিস্ট ফিরোজ ও তার পরিবারের সদস্যরা।
কার্টুনিস্ট ফিরোজের স্ত্রী শিউলি আরা খাতুন কালবেলাকে বলেন, বিখ্যাত একজন কার্টুনিস্টের জীবন এমন হবে ভাবতেও পারিনি। আমিসহ স্বামী বাচ্চাদের চিত্রাঙ্গন ও হাতের লেখা সুন্দর করার ক্লাস নেই। বর্তমানে দুজনই অসুস্থ। আমার চোখের পাতা হঠাৎ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসকরা বলেছেন চোখের যে সূহ্ম ভেইন আছে সেগুলো শুকিয়ে গেছে। এটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা। তারপরও স্বামী সেই চিকিৎসাও করিয়েছে। কিন্তু তিনি নিজেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তার সুচিকিৎসা করাতে না পারলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হবে। কিন্তু এতো টাকা জোগাড়ের সমর্থ নেই। তাই সরকার যদি বিখ্যাত এই কার্টুনিস্টের প্রতি একটু সুনজর দিতো তাহলে অন্তত তার চিকিৎসাটা করাতে পারতাম।
মন্তব্য করুন