নারীরা এখন নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। এভারেস্ট জয় করছে, পাইলট হয়ে বিমান চালাচ্ছে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করছে এবং সফলও হয়েছে। কিন্তু নারী হয়ে জীবন যুদ্ধে সংগ্রাম করে সফল হওয়া সবচেয়ে কঠিন। বলছিলাম জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী এক সফল নারীর কথা।
তার নাম বাঘবিধবা হালিমা খাতুন। কয়রা বাজারে চায়ের দোকানের ব্যবসা করে উপার্জন করছেন। ঘুচেছে আর্থিক দৈন্য, বেড়েছে সামাজিক সম্মান। সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে তার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। সমাজের নানা আচার অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। তার এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পের কারিগর উপকূলের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি)। আইসিডি সুন্দরবন তীরবর্তী উপকূলীয় জনপদের বাঘবিধবাদের পুনর্বাসনে কাজ করছে। এই প্রকল্পে সহায়তা করছে ‘লিটিল কাইন্ডনেস মেক্স এ বিগ ইমপ্যাক্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
হালিমা খাতুনের দোকানে চা খেতে খেতে বায়জিদ হোসেন বলেন, হালিমার দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো আমরা চোখের সামনে দেখেছি, এখন সে স্বাবলম্বী। আমরা অনেক খুশী, তার জীবনের এই পরিবর্তন দেখে।
স্থানীয় বাসিন্দা ননী গোপাল মজুমদার বলেন, আমি হালিমার চায়ের দোকানের নিয়মিত কাস্টমার। হালিমার স্বামী সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হন। এরপর থেকে অনেক দুঃখ-কষ্টে দিন পার করত। আগে বাসাবাড়ি এবং হোটেলে কাজ করত, কিন্তু তার হার্টের সমস্যার কারণে আগের মতো ভারি কাজ করতে পারে না। এখন চায়ের দোকান করে সে স্বাবলম্বী।
বাঘবিধবা হালিমা খাতুন বলেন, প্রতিদিন চায়ের দোকান থেকে ভালো আয় হচ্ছে। এখন ঠিকমতো দু’মুঠো ডাল-ভাত খেতে পারি। আয়ের ক্ষুদ্র অংশ সঞ্চয় করছি। এলাকার মানুষ এখন সম্মান করে। আমার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প মানুষের মুখে শুনতে ভালো লাগে। বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে কোনো রকম দু’মুঠো ভাত খেতে পারতাম। হার্টের সমস্যার কারণে ভারী কাজ করতে পারি না বলে ঝিয়ের কাজ হারাই। চরম দুশ্চিন্তা আর হতাশার মাঝে আইসিডি আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।
বাঘবিধবা হালিমা খাতুনের বাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নে ২০০৭ সালে হালিমা খাতুনের স্বামী আলমগীর হোসেন গাজী সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়। তার সঙ্গে থাকা সঙ্গীরা স্থানীয়দের খবর দিলে অনেক খোঁজাখুঁজি করে দুই দিন পর আলমগীরের লাশ খুঁজে পায়। ততক্ষণে শরীরের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে বাঘ। পরে বাঘের মুখ থেকে উদ্ধার করা ক্ষতবিক্ষত শরীরের অংশ বাড়িতে এনে কবর দেওয়া হয়। তখন তিনি ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। একমাত্র সন্তানের মুখ তার পিতা দেখে যেতে পারেনি। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবনে অবর্ণনীয় কষ্ট নেমে আসে। শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন ও অভাব-অনাটন সহ্য করতে না পেরে খুলনা শহরে চলে যায় কাজের সন্ধানে। চালের মিলে কাজ করতে গিয়ে মেশিনে কাপড় জড়িয়ে মর্মান্তিকভাবে আঘাত পায়। ১ মাস হাসপাতালে থাকার পর মিলের কাজ হারিয়ে তখন রেললাইনে শাক-সবজি বিক্রি করত। অভাব লেগে থাকত বলে মেয়েকে নিয়ে শহর থেকে গ্রামে চলে আসে। কয়রা উপজেলায় ছোট একটা ঘর ভাড়া করে বাসাবাড়ি ও হোটেলে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালায়। হার্টের সমস্যার কারণে ভারী কাজ না করতে পারায় সেই কাজ হারায়। তার এই কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে আইসিডি।
আইসিডির কো-ফাউন্ডার মো. আশিকুজ্জামান বলেন, হালিমা খাতুনের মতো আরও অনেক বাঘবিধবাকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছি। যারা এই উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা করছেন তাদের অনেক কৃতজ্ঞতা।
মন্তব্য করুন