‘ডাকের চিঠি! ছেলেবেলার এক আবেগের নাম। ছিল না যোগাযোগ ব্যবস্থা। চিঠিতেই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার হতো বহিঃপ্রকাশ। কাছের মানুষ দূরে কোথাও মারা গেছে, ১০ থেকে ১৫ দিন কিংবা এক মাস পর খবর আসত চিঠিতে। চিঠি পেয়ে পড়ে যেত কান্নার রোল। আবার জন্ম কিংবা চাকরির খবরের চিঠি পেলে আনন্দে আত্মহারা হতাম। ডাকবিভাগের খামের সেই চিঠি, ওপরে ডাকটিকিট আবার কখনো বা পোস্টকার্ড। সবই এখন হারিয়ে গেছে। চলে গেছে স্মৃতিতে, থেকে গেছে ইতিহাস হয়ে। ইন্টারনেটের যুগে চিঠির সেই আবেগ যে আর নেই। পৃথিবীর যেখানেই থাকি, অন্য প্রান্তের সঙ্গে রোজই কথা হচ্ছে, দেখা হচ্ছে। কাজেই ইন্টারনেটের গতি এসে ডাকের চিঠির সেই আবেগকে হারিয়ে দিয়েছে।’
ছোটবেলায় ডাকের চিঠির গুরুত্ব ও আবেগ নিয়ে কালবেলার কাছে এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলার সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিন।
ইন্টারনেট এসেছে, দেশ ডিজিটাল হয়েছে। হারিয়ে গেছে চিঠির সেই স্মৃতিময় আবেগ। কিন্তু দেশের ডাক বিভাগ তুলনামূলক এগোয়নি। ডাক বিভাগ নিয়ে আখলাকুচ্ছাফা নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘বর্তমানে চাকরির পরীক্ষার প্রবেশপত্র অনলাইনে ডাউনলোড করে নিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু বছর পাঁচেক আগেও ডাকযোগে প্রবেশপত্র আসত। জীবনে চাকরির অনেক পরীক্ষা দিয়েছি। তবে জীবনে তিনবার ডাকযোগে প্রবেশপত্র আসার আগেই পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় চাকরির সেই পরীক্ষাতে অংশ নিতে পারিনি। আমার মনে হয়, প্রবেশপত্র আগেই এসেছিল, পোস্টমাস্টার কিংবা রানারের গাফিলতির কারণে এমনটা হয়েছে।’
তবে রানারের কোনো গাফিলতি নেই বলে জানালেন রাজশাহী জিপিও থেকে পবার দামকুড়া পোস্টঅফিসে নিয়মিত চিঠি ও পার্সেলবহনকারী রানার মো. খালেদ হোসেন অপু। তিনি বলেন, ‘আমি ২৭ বছর থেকে রানার হিসেবে কাজ করছি। দীর্ঘ এ সময়ে মাত্র চার দিন ছুটি নিয়েছি। রোদ-বৃষ্টি, ঝড় মাথায় নিয়ে ২৭ বছর থেকে সাইকেল নিয়ে প্রতিদিন ছুটেছি চিঠি আর পার্সেল নিয়ে। এক দিন প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম। রাস্তায় একটি গাছের মোটা ডাল ভেঙে শরীরে পড়ল। আহত হলাম, ছিঁড়ে গেল শরীরের জামা। তার পরও খালি গায়েই নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছি চিঠি, কখনো গাফিলতি করিনি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার রাজশাহীর সভাপতি ও রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই ডাকঘরেই ছিল আস্থা। কেননা, ওই সময় একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা পোস্ট অফিস কেন্দ্রিকই ছিল।
ডিজিটালাইজেশনে ডাক সেবায় ডাক বিভাগ কুরিয়ার সার্ভিস পেছানোর কারণ হিসেবে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের রাজশাহী শাখার ইনচার্জ মো. মাসুদ রানা বলেন, ‘গ্রাহকরা যে ডকুমেন্টস ডাকবিভাগে বুকিং করে, তা গন্তব্যে পাঠাতে দেরি হয়ে যায়। এটি যারা বিলি করে তাদের গাফিলতি। পক্ষান্তরে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো গ্রাহকের কোনো ডকুমেন্টস বুকিং করার পর একটা এসএমএস পাঠানো হয়। আবার অনলাইনে দেখতে পায় গ্রাহকের পাঠানো ডকুমেন্টস কোথায় আছে। এই যে আস্থার জায়গা, এটি ডাক বিভাগ করতে পারেনি। আমরা বিশ্বের যে কোনো দেশে ডকুমেন্টস-নন ডকুমেন্টস পার্সেল পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে ডেলিভারি দিই। কিন্তু ডাক বিভাগ সেটি না পারার কারণেই পিছিয়ে আছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় এক যুগ থেকে ডাক বিভাগ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু উত্তরাঞ্চলের শহর কিংবা উপজেলা সদরের ডাকঘরগুলোর সেবার মান কিছুটা ভালো হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মান আগের চেয়ে কমে গেছে। কারণ, আগে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিঠির আদান-প্রদান থাকলেও বর্তমানে এটির প্রচলন নেই। তা ছাড়া অন্যান্য পার্সেল ডাকযোগে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো এখন যায় না বললেই চলে। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পোস্টমাস্টার কিংবা পিয়নের বেতন বর্তমান যুগের তুলনায় একেবারে নগণ্য।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার পালিবাজার ব্রাঞ্চ পোস্টমাস্টার আতাউর রহমান বলেন, ‘১৯৯৫ সালের মাত্র ৪৭৪ টাকা ভাতায় এই পোস্ট অফিসে মাস্টার হিসেবে যোগদান করি। দীর্ঘ ২৯ বছর পর এখন ভাতা পাই মাত্র ৪ হাজার ৪৬০ টাকা। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। এই ভাতায় আমাদের জীবন চলে না। আমরা কোনোদিন মাছ-মাংস কিনতে পারি না, খুব কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে। তাই সরকারের কাছে আবেদন, সম্মানজনক একটি ভাতার যেন ব্যবস্থা করে।’ উত্তরাঞ্চলের পোস্টমাস্টার জেনারেলের কার্যালয়ের অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল ড. মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, ‘ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই চিঠিপত্র, পার্সেল, সঞ্চয় ব্যাংক, সঞ্চয়পত্রের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর সেবাগুলো ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে এসেছে। অভ্যন্তরীণ পার্সেলগুলো পজ মেশিনের মাধ্যমে বুকিং এবং ডেলিভারির ফলে গ্রাহকরা তাদের চিঠির অবস্থান জানতে পারেন।
ডাক বিভাগ ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের বিভিন্ন স্কিম অটোমেশনের আওতায় এনেছে। এতে টাইম, কস্ট এবং ভিজিট কমে গেছে। একসময় একজন পরিবার সঞ্চয়পত্রের গ্রাহককে ৫ বছরে ৬০ বার পোস্ট অফিসে আসতে হতো, সেখানে এখন মাত্র দুবার আসতে হয়। গ্রাহকের মুনাফার টাকা প্রতিমাসে তার অ্যাকাউন্টে চলে যায়। গ্রাহক সুবিধামতো অ্যাকাউন্ট থেকে তার টাকা তুলে নিতে পারে। সুতরাং ডাক বিভাগ গ্রাহক সর্বোচ্চ সেবা দিতে বদ্ধপরিকর।’
মন্তব্য করুন