মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কাদিপুর শিববাড়িকে বলা হয় সিলেটের সবচেয়ে সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন মন্দির। প্রায় ১৫০ বছরের পরিক্রমায় এ বছরও এই শিববাড়িতে অনুষ্ঠিত হবে দুর্গাপূজা। প্রাচীন কারুকার্যময় মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী এক অপরূপ নিদর্শন কাদিপুর শিববাড়ি যা আকর্ষণ বাড়ায় সবার মনে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা আগামী বুধবার (৯ অক্টোবর) দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। পাঁচদিনব্যাপী ওই উৎসবের শেষ হবে ১৪ অক্টোবর প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।
গত ২০২২ সাল থেকে শিববাড়িতে ২৩ ফুট উঁচু সহস্রভুজা (এক হাজার হাতের) দুর্গা প্রতিমার পূজা চলে আসছে। ইতোমধ্যে শিববাড়ি মন্দির পরিদর্শন করেছেন জেলা পুলিশ সুপার এমকেএইচ জাহাঙ্গীর হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদর্শন কুমার রায় ও দীপঙ্কর ঘোষ, ওসি মো. গোলাম আপছার ও সেনাবাহিনীর টহল টিম।
শনিবার (৫ অক্টোবর) সরেজমিনে শিববাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শিববাড়ির সৌন্দর্য রং-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রবেশ মুখ থেকে বাড়ির ভেতর পর্যন্ত পাকা সাদৃশ্য একাধিক তোরণ রয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে বাড়ির ভেতর পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ ফুট রাস্তা আরসিসি ঢালাই করা হয়েছে দর্শনার্থীদের চলাচলের সুবিধার্থে। বাড়ির ভেতরে পাশাপাশি তিনটি মন্দির। ‘আনন্দ সেবাধাম’ নামের মন্দিরের দোতলায় ২০২২ সালে লাল রং দিয়ে এক হাজার হাতের দুর্গা প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে। সিমেন্টের তৈরি এই প্রতিমার উচ্চতা ২৩ ফুট। এ বছর নতুন করে বড় দুটি মন্দিরের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে। ‘শ্রী শ্রী ভৈরবী মা’ নামে আরেকটি মন্দির।
শিববাড়ির বাসিন্দা আচার্য্য পুলক সোম বলেন, প্রখ্যাত বেতার সম্প্রচারক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চণ্ডী পাঠের সময় দেবী দুর্গাকে কখনো দশভুজা, কখনো অষ্টাদশভুজা আবার কখনো সহস্রভুজা উল্লেখ করেছেন। মহিষাসুর বধের সময় দেবী যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, তাতেও তিনি সহস্রভুজা ছিলেন। তাই লাল রং দিয়ে সহস্রভুজা দুর্গা প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। এটা চলবে প্রতিবছর। তবে প্রতিমার বিসর্জন হবে না।
পুলক সোম আরও বলেন, রং তুলির ছোয়া প্রায় শেষ হয়েছে, পূজার সময় এগিয়ে আসছে। এবার রাত ১১টার পর প্রধান ফটক বন্ধ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সবার সহযোগিতায় এবারও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পূজা উদযাপন করা হবে। নিরাপত্তার জন্য শিববাড়ির বিভিন্ন স্থানে ২০টি সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, এই বাড়ির স্বর্গীয় অনঙ্গ কুমার সোম ছিলেন জমিদার বংশের। এই বংশের কোনো এক বংশধর তাদের দীঘিরপাড়ে বেলগাছের নিচে নিয়মিত শিবের সাধনা করতেন। সাধনা করলেও তখনও এ বাড়িতে কোনো শিবলিঙ্গ ছিল না। তাদের কুলদেবতা হচ্ছেন কানাই লাল (রাধাকৃষ্ণ)। পূর্বপুরুষগণ সম্পত্তির অনেকটা দেবত্তর করে দিয়েছিলেন কুলদেবতার নামে। পরে অনঙ্গ কুমার সোমের পুত্র স্বর্গীয় অজিত কুমার সোমের পরবর্তী বংশধর পুলক সোমের সাধনায় ১৪০৫ বঙ্গাব্দে (১৯৯৮ খ্রি) শ্রাবণের ১৮ তারিখ শিবলিঙ্গটি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় সেই শিবলিঙ্গটি ১৫০ বছর পূর্বেকার। পরে পুরোনো মন্দিরটি সংস্কার করে সেখানেই শিবলিঙ্গটি স্থাপন করা হয়। শুরু হয় প্রতি সোমবারে সোমনাথ (শিব) পূজা। আসতে শুরু করেন ভক্তগণ। নিজেদের প্রার্থনা জানিয়ে শিবের পূজা শুরু হলে মন্দিরের উন্নয়নও শুরু হয় ভক্তদের আর্থিক সহায়তায়। তৈরি হয় অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির। যা ভক্তদেরকে আকৃষ্ট করে। ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের লাখো ভক্ত।
জানা যায়, শিববাড়ির পূর্বপুরুষদের জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘটলে একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার পরিবার চরম আর্থিক সংকটে পরে। ফলে প্রায় ৩১ বৎসর দেবী দুর্গার ঘটপুজা তারা করেন। তখন সেই বনেদী পূজা-পার্বণে আকাশছোঁয়া জৌলুস হারিয়ে গেলেও তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে একবিন্দু ঘাটতি পড়েনি। পরে ২০০১ সালে জমিদারী বাড়ির মন্দিরটি জৌলুস ফিরতে শুরু করে, যা এখনো চলছে। প্রতিবছর দুর্গাপূজায় লাখো ভক্তদের ভিড়ে মুখর হয়ে উঠে অনিন্দ্যসুন্দর এ মন্দিরটি।
কুলাউড়া উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য সচিব অজয় চন্দ্র দাস বলেন, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সর্বজনীন ১৯৭ ও ব্যক্তিগত ১৮টিসহ মোট ২১৫ টি মণ্ডপে এবার শারদীয় দুর্গোৎসব হচ্ছে। এর মধ্যে শিববাড়িতে ভক্তদের সমাগম হয় সবেচেয়ে বেশি। শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপন করতে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণিপেশার মানুষ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সবধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে।
কুলাউড়া থানার ওসি মো. গোলাম আপছার বলেন, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মোট ২১৫টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপনে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে বিট পুলিশিং, সর্বদলীয় নিরাপত্তা কমিটি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ করা হচ্ছে। সবকটি পূজা মন্দির পরিদর্শন করা হয়েছে। এ ছাড়া পূজাকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরণের গুজব রোধে সবাই পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাচ্ছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, সিলেটের সর্ববৃহৎ কুলাউড়ার শিববাড়ি মন্দিরের দুর্গাপূজায় সর্বশেষ প্রস্তুতি খুবই সন্তোষজনক। অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছরও আরও বেশি উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপন হবে। শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর করতে প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার বাহিনী সম্মিলিতভাবে কাজ করছে।
মন্তব্য করুন