রেজওয়ান রনি, রংপুর
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০১:১৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন টুকটুকির

পড়াশোনায় ব্যস্ত রংপুর নগরীর মুসলিমপাড়া রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা শিশু টুকটুকি। ছবি : কালবেলা
পড়াশোনায় ব্যস্ত রংপুর নগরীর মুসলিমপাড়া রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা শিশু টুকটুকি। ছবি : কালবেলা

কয়েক মাস আগের কথা। রংপুর নগরীর মুসলিমপাড়া রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা শিশু টুকটুকি শহরের বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করত। গালমন্দ, নির্যাতন ছিল নিত্যসঙ্গী। সেই টুকটুকি এখন পথ ছেড়ে পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নপূরণে চায় সহযোগিতা।

মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) বিকেলে মুসলিমপাড়া রেলওয়ে কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যুৎবিহীন ঘরে লণ্ঠনের আলো জ্বালিয়ে বই পড়ছে। কথা হলে টুকটুকি বলে, ‘আগে ভিক্ষা করতাম, মানুষ মারত। এখন বই পড়ি। বই পড়ে বড় হয়ে পুলিশ হবো। পুলিশ হলে আর কষ্ট থাকবে না। সব অপরাধীকে শাস্তি দেব।’

টুকটুকি মুসলিমপাড়া রেলওয়ে কলোনির পাশে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘জুম বাংলাদেশ স্কুলের’ শিশুশ্রেণির শিক্ষার্থী। মা-বাবা ও ভাইদের নেশার টাকা জোগাতে সে পথে পথে ভিক্ষা করত। ভিক্ষা করতে গিয়ে পথে যেমন নির্যাতনের শিকার হতো, তেমনি দিনশেষে খালি হাতে ফিরলে বাড়িতে মারধরের শিকার হতো।

টুকটুকির মা মুক্তা বেগম বলেন, ‘হেরোইন খাইতাম, নেশা উঠলে মাথা ঠিক থাকত না। স্বামী, সন্তানরাও নেশা করে। নেশার টাকার জন্য বাচ্চাটারে ভিক্ষা করাইতাম। স্যারেরা বোঝানোর পর ওরে স্কুলে ভর্তি করাই দিছি। আমিও নেশা ছাড়ছি। মেয়েটা পুলিশ হবার চায়, আমি তো গরিব ওরে খাওন দিবার পারি না। কারেন্ট বিল বাকি থাকায় মিটার কাটি দিছে। কুপির আলোত বই পড়ে, ভাত খাই।’

একই এলাকার ৮ বছরের ইয়াছিন আলীও পথের জীবন ভুলতে চায়। কয়েক বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর রাস্তায়, ডাস্টবিনে পড়ে থাকা প্লাস্টিক-পলিথিন কুড়িয়ে ক্ষুধার জ্বালা মেটাত সে। পাঁচ বোন, চার ভাইয়ের সংসারে কেউ কারও খোঁজ না রাখায় পথেই পড়ে থাকত ইয়াছিন। সেই ইয়াছিন এখন স্কুলে যায়। দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত স্টেশন এলাকায় আমড়া বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে।

ইয়াছিন বলে, রাস্তায় পলিথিন টুকাইতাম। সারা দিন নোংরা কাপড়, গায়ে দুর্গন্ধ লেগে থাকত। এখন আমি স্কুলে যাই। স্কুল শেষ করে আমড়া বেচে লাভের টাকা মাকে দিই। আমার স্বপ্ন লেখাপড়া করে সেনাবাহিনীর কমান্ডার হবো।

টুকটুকি ও ইয়াছিন পথ ছেড়ে স্কুলে গিয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তাদের মতো অনেক শিশুর ঠিকানা হয়েছে নগরীর পথে পথে। অসচেতনতা, দারিদ্র্য, মাদকাসক্তই পথশিশু বৃদ্ধির মূল কারণ বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কে, পার্কে, কলেজে, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল, সড়কের মোড়সহ জনবহুল এলাকায় পথশিশুরা দলবেঁধে মানুষের কাছে টাকা চাইছে। টাকা না পেলে হাত টেনে, পা আঁকড়ে বসে পড়ছে। কেউ তাদের টাকা দিচ্ছে, কেউ আবার গালমন্দ করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। টাকা পেলেই কেউ কেউ পলিথিন হাতে ড্যান্ডি সেবন করছে। কেউ কেউ ঝুঁকে পড়ছে গাঁজা ও হেরোইনের মতো মাদকে। মাদকের টাকা জোগাতে এসব পথশিশু চুরি, ছিনতাইর মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, একটি শিশুর শিশুকালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। একজন মানুষ হিসেবে আনন্দময় শৈশব, সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে হবে। একটি পথশিশুর খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্র যৌক্তিকভাবে তা কতটুকু করতে পারছে, প্রশ্ন থেকে যায়। তাদের সুন্দর জীবন, শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যর্থ হবে।

পথশিশুদের নিয়ে কথা হলে বিভাগীয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, পথশিশুদের পুনর্বাসনে আমাদের কমিটি আছে। এরই মধ্যে রংপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫০ পথশিশুকে আমরা চিহ্নিত করেছি। ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব শিশুর পুনর্বাসনে কাজ করছি। আমাদের হাবে ৩৫ পথশিশুকে খাবার, শিক্ষা, খেলাধুলা ও বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পথে থাকা শিশুদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ রকম পথশিশুদের খবর পেলে আমাদের সমাজকর্মীরা সেখানে গিয়ে তাদের ডাটাবেজ তৈরি করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছি। আমাদের বিভাগীয় কার্যালয়ের একজন সাইকো সুপার কাউন্সিলরের মাধ্যমে তাদের কাউন্সেলিং করে স্বাভাবিক পথে ফেরানো হচ্ছে। তারা চাইলে শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্রে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সব ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকি। রংপুর বিভাগজুড়ে ৭৬৫ জন ও রংপুর জেলায় ১১১ শিশুকে প্রতি মাসে দুই হাজার করে শিশু সুরক্ষা ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

লেবাননের হামলায় ইসরায়েলের দুই সেনা নিহত, আহত ১৮

গোলাপ, এস কে সুর, রাজউকের উজ্জ্বলকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি ৬ দিন বন্ধ

নরসিংদীতে আ.লীগ নেতা জাহাঙ্গীর গ্রেপ্তার

নিষিদ্ধ মার্তিনেজ, আর্জেন্টাইন কোচের ভাবনায় কে?

ঢাবি শিবিরের নতুন কমিটিতে থাকা আল আমিন হয়েছিলেন ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম

অতিরিক্ত আইজিপি পদোন্নতি পাচ্ছেন ৬ ডিআইজি

আবারও বাড়ল এলপিজির দাম

অফিসার পদে নিয়োগ দিচ্ছে গাজী গ্রুপ

নাশকতার মামলায় আ.লীগের ১২ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার

১০

কিশোরগঞ্জে আ.লীগের ৫ নেতা গ্রেপ্তার

১১

ইসরায়েলে ইরানের হামলা নিয়ে যা বলছে জর্ডান

১২

ইরানের হামলা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া

১৩

শেষ আশ্রয়টুকুও হারালেন শহীদ দেলোয়ারের বৃদ্ধা মা

১৪

ইসরায়েলকে থামাতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান এরদোয়ানের

১৫

ছাত্র আন্দোলনে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়নি, দাবি র‌্যাবের

১৬

কুষ্টিয়া সীমান্তে সতর্কতা জারি

১৭

জিতের ‘লায়ন’

১৮

৫৩ শতাংশ ভোটার মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দুবছর হওয়া উচিত : জরিপ

১৯

ইসরায়েলে লেবাননের রকেট বৃষ্টি

২০
X