আরব্য রজনীর রূপকথাকেও হার মানিয়েছে অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট আনোয়ার হোসেনের উত্থানের গল্প। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাড়াডোব গ্রামের কিয়াম উদ্দিনের ছেলে আনোয়ার (৩২)। একদিকে তার বিরুদ্ধে চলছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের মানি লন্ডারিং অনুসন্ধান, অন্যদিকে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে যাচ্ছেন বিকাশ কর্মী থেকে অনলাইন জুয়ার মাফিয়া এজেন্ট বনে যাওয়া এই আনোয়ার।
তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের তদন্ত চলমান বলে কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এবং মেহেরপুর জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট।
২০২২ সালে অনলাইন জুয়ায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান আনোয়ার। এক সময় পাড়ি জমান দুবাইয়ে। কয়েক বছর যাবত সেখান থেকেই চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ অনলাইন জুয়ার সাম্রাজ্য। বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে মাঝে মধ্যেই দেশে এসে সম্পদ কিনছেন নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে, আবারো ফিরে যাচ্ছেন দুবাইয়ে। এভাবেই থেকে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
কিছুদিন আগে চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি দুবাই থেকে বাংলাদেশে এসেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সূত্র বলছে তিনি বেশ কয়েকদিন মেহেরপুরে অবস্থান করছেন এবং সবাইকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় আছেন এবং দুবাই ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মেহেরপুর থেকে ঢাকা যাওয়ার পর আনোয়ার তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আনন্দ ভ্রমনে গিয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আনোয়ার নিজেই সে ছবি পোস্ট করেছেন।
সূত্রটি বলছে, বিকাশের ডিস্ট্রিবিউটর সেলস অফিসার হিসেবে চাকরিকালীন সময়ে তিনি মাসে বেতন পেতেন ১১ হাজার টাকা। করোনাকালীন সময় মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় জুয়াড়িদের কাছে বিকাশের এজেন্ট সিম সরবরাহ করতে করতে তিনি নিজেই অনলাইন জুয়ার হোতা বনে যান। আর এ ৪ বছরে বনে গেছেন কয়েক কোটি টাকার মালিক। জনশ্রুত তার সম্পদের পরিমাণ শতকোটি টাকারও বেশি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুলত ২০২০ সালে করোনার সময় তিনি অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মাদার আলীকে সিম সরবরাহ করতে গিয়ে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। চাকরির বেতনে কোনোমতে সংসার চালানো আনোয়ার বছর ঘুরতেই কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। আর অনলাইন জুয়ার আয় থেকে শুরু সম্পদ কেনা ও ব্যবসা বাণিজ্য।
আরও জানা যায়, ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট তৎকালীন অন্যতম শীর্ষ এজেন্ট বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েলকে আটক করে মেহেরপুর জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। রয়েল পুলিশের কাছে তিনিসহ আরও ১৫ জন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হিসেবে জড়িত বলে স্বীকারোক্তি দেয়। বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েলের স্বীকারোক্তিতে সেই মামলায় ১৫ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে আনোয়ার হোসাইনের নামও ছিল। কিন্তু মামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত আনোয়ার হোসাইন রয়ে গেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আনোয়ারের সম্পদ অনুসন্ধানে আপাতভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, আনোয়ার হোসাইন অনলাইন জুয়া থেকে আয় করা টাকা দিয়ে ২০২১ সালের ২২ জুন তারিখে ফৌজদারি পাড়ার আশরাফুল ইসলাম ও তার ভাইদের সঙ্গে ৬ কাঠা জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য করা হয়েছে ৬০ লাখ টাকা, দলিল নম্বর-৩৫৬৬/২১।
২১ সালের ২১ ডিসেম্বর মেহেরপুর শহরের তাহের ক্লিনিকের সামনে প্রধান সড়কের (মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়ক) পাশে ৯৪ লাখ টাকা দলিল মূল্যে চার কাঠা জমি কিনেছেন। আর সেই জমি রেজিষ্টি করতে মহুরী খরচসহ লেগেছে আরো ১০ লাখ টাকা। যার দলিল নম্বর ৬৯৮২/২১।
পৌর শহরের পিয়াদা পাড়াতে ২০২২ সালের ২৮ জুন সাড়ে ১৪ শতক জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য করা হয়েছে ৪০ লাখ টাকা, দলিল নম্বর-৩৮৪১/২২। এতে রেজিস্ট্রি ও মহুরি খরচ লেগেছে আরও ৬ লাখ টাকা।
মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের কাটাইখানার সামনে আজিজুল হকের মেয়ে সুমনা হকের কাছে থেকে ২০২২ সালের ১৯ জুলাই ৯ শতক জমি কিনেছেন। যার দলিল মূল্য করা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। দলিল নম্বর-৪২৭০/২২। ক্রয় কৃত সবগুলো জমির প্রকৃত বাজার মূল্য দলিল মূল্য থেকে অনেক বেশি।
এ ছাড়াও, গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের কাঁচারি বাজারে মরিয়ম হার্ডওয়ার এন্ড ইলেকট্রনিক্স নামে চারটি দোকান নিয়ে ব্যবসা করছেন। আর ধানখোলা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন ২০২৩ সালের ১৩ অক্টোবর। চারটি দোকানের জন্য জামানাত দিয়েছেন সাড়ে ১১ লাখ টাকা। দোকানটি পরিচালনা করেন তার এক ভাইরা।
আনোয়ার হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের বাকি তথ্যের অনুসন্ধান চলমান। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকাতে স্ত্রীর নামে কেনা ৪ টি ফ্ল্যাট এবং মেহেরপুর সদর উপজেলার একাধিক স্থানে তার নিকটাত্মীয়ের নামে কেনা কয়েক বিঘা জমি।
মেহেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) আহসান খান কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে আমি একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ঢাকায় অবস্থান করছি। আমি অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট আনোয়ারের কথা শুনেছি। আমি জানি তিনি পলাতক। তবে দুবাই থেকে বাংলাদেশে এসেছে এমন কোন তথ্য আমার জানা নাই। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব। বর্তমানে তার অবস্থান বাংলাদেশে হলে তাকে আমরা এবার আটকে ফেলবো।
উল্লেখ্য, রাশিয়া থেকে পরিচালিত হচ্ছে অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস। তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ব্যবহার করে প্রত্যেক এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ২৩০টি সাইটের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে গত আড়াই বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে টাকা পাচার হয়েছে বলে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি।
মন্তব্য করুন