‘ছেলের বিছানা প্রতিদিন পরিষ্কার করি। ১০ বছর ছেলের বিছানায় কাউকে ঘুমাতে দিইনি। কারণ এই বিছানায় আমার বুকের মানিক এসে ঘুমাবে। আল্লাহর কাছে বলি, তুমি আমাকে ধৈর্য দাও। ছেলে বেঁচে থাকলে ফেরত দাও, না থাকলে সেই খবরটি দাও।’
কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩ সালে গুম হওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম রাসেলের মা মজিদা বেগম।
তিনি বলেন, মায়ের চোখের পানি কখনো শেষ হয় না। কাঁদতে কাঁদতে আমার দুটা চোখে অসুখ হয়ে গেছে। চোখে অপারেশনও করা হয়েছে। আমি প্রথম পাঁচ-সাত বছর গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। গাছের পাতায় আমার ছেলের ছবি ভেসে উঠত। ভালো রান্না করি না কত বছর হয়ে গেছে। আমাদের কাছে ঈদ বলতে কিছু নাই। রাতের ১২টা-১টায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। যদি পাগলের বেশে ছেলে আমাকে দেখতে আসে। বাজারে গেলে বা গাড়িতে উঠলে অন্যান্য ছেলেদের মুখের সঙ্গে ছেলের ছবি মিলাই। যদি মিলে যায়। আমি আমার ছেলেকে ফেরত চাই। যারা গুম করেছে তাদের বিচার চাই।
রাসেলের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, শেরপুরের নকলা উপজেলার ধুকুরিয়া গ্রামের ব্যবসায়ী মো. আমিনুল ইসলামের তিন সন্তানের মধ্যে মেজো ছেলে রাসেল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছিলেন প্রথম বিভাগ নিয়ে। ২০১৩ সালে মাস্টার্স শেষ করার পর পড়াশোনা শুরু করে আইন বিভাগে। পড়ালেখা ভালো হওয়ায় তার বাবা-মা স্বপ্ন দেখতেন ছেলে একদিন বিসিএস ক্যাডার হবে।
৩৪তম বিসিএস এ লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন আমিনুল। এরপর শুরু করেন ভাইবার জন্য প্রস্তুতি। তবে পড়াশোনা পাশাপাশি সে একজন মেধাবী ছাত্রনেতা ছিলেন। তৎকালীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। তবে তার নামে একটাও মামলা ছিল না। তার ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার পশ্চিম নাখালপাড়া এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের এক মাস একদিন আগে ২৫ বছর বয়সী রাসেল নিখোঁজ হয়। যার এখনো খোঁজ মিলেনি। তবে পরিবারের দাবি র্যাব-১ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তৎকালে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এই ঘটনায় বেশ কয়েকটি খবর ছাপা হয়। সেই খবরগুলোতে র্যাবের পক্ষ থেকে তুলে নেওয়ার ব্যাপারে বারবারই অস্বীকার করা হয়।
রাসেলের গুম হওয়ার সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে তার ছোট বোন নুসরাত জাহান লাবনী বলেন, দিনটা ছিল ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আই ব্লক থেকে ভাইয়ার চার বন্ধুসহ মোট ছয়জনকে তুলে নিয়ে যায় র্যাব-১। এ সময় একটি নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের নিচ থেকে তাদেরকে তুলে নেওয়ায় তখনকার কর্মরত শ্রমিকরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ সময় র্যাবের পোশাক পরিহিত এবং র্যাব-১ এর স্টিকার লাগানো দুটি গাড়িসহ কয়েকটি সাদা গাড়ি তাদের সঙ্গে ছিল। পরবর্তী সময়ে থানায় জিডি করার সময় জিডিতে র্যাবের নাম লেখার কারণে তারা জিডি না নিয়ে আমাদের ফিরিয়ে দেন। পরবর্তীতে নিখোঁজ হিসেবে আমরা থানায় জিডি করতে বাধ্য হই।
তিনি আরও বলেন, র্যাব-১ তখন বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও অস্বীকারও করেনি। তারা আমাদেরকে বলেছে, দেখি নির্বাচনের পরে কী করা যায়। এ ছাড়া আমরা র্যাবের দপ্তরে দিনের পর দিন যেতাম। কখনো সকালে যেতাম রাতে আসতাম। তারা আমাদের সঙ্গে কখনো কথা বলত, কখনো কথা বলত না। তৎকালীন র্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার ছিল কিসমত হায়াত। কিসমত হায়াত আমাদের একবার তৎকালীন র্যাবের ডিজি মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তখন আমরা বুঝতে পারি ডিজি বলে দিলেই ভাই ছাড়া পাবে। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই প্রাইভেট নম্বর থেকে ফোন দিয়ে আমাদের হুমকি দেওয়া হতো। বলতো তোমরা যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর তাহলে তাকে মেরে ফেলা হবে।
গুম হওয়া রাসেলের বাবা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলের সঙ্গে তারেক রহমানের ভালো সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন সময় তারেক রহমানের নির্দেশে সে কাজ করত। এর জন্যেই আমার ছেলে আওয়ামী লীগের টার্গেট হয়েছে। গুম হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ সময় আমি আমার ছেলেকে খোঁজাখুঁজি করেছি। শরীর, মন ও অর্থে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমি কীটনাশকের ছোট একটা ব্যবসা করি। এই ছেলের সন্ধানে ব্যবসা বন্ধ রেখে একটা ব্যাগে কাপড় নিয়ে মাসের পর মাস ঢাকা শহরে বিভিন্ন অফিস আদালতের বারান্দায় কাটিয়েছি।
তিনি বলেন, তৎকালীন র্যাবের ইন্টেলিজেন্স টিমের দায়িত্বে ছিলেন জিয়াউল আহসান। আমি জিয়াউল আহসানের দুই পা জড়িয়ে ধরে কান্না করেছি। এতেও তার মন গলেনি। সে উল্টা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে লাথি মেরেছে। গুম হওয়া মানুষদের জীবিত ফেরত চাই। যদি তাদের মেরে ফেলা হয় তারও ফয়সালা চাই আমরা। গুমের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই।
নকলা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মাহমুদুল হক দুলাল বলেন, রাসেল ঢাকায় পড়াশোনা ও ছাত্ররাজনীতি করলেও নিয়মিত এলাকার খোঁজখবর রাখতেন। মেধাভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির চর্চা করত সে। তাকে নিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ রাজনীতির স্বপ্ন দেখতাম। সে ঢাকা থেকে শেরপুরে এসে মাঝেমধ্যেই নকলায় দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করত। আমি বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার আমলে গুম হওয়া যেসব ব্যক্তির এখানো হদিস পাওয়া যায়নি তাদের আমরা জীবিত ফেরত পাব। সরকারের কাছে রাসেলের সন্ধান চাই এবং জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হোক।
মন্তব্য করুন