চিকিৎসকদের টানা কর্মবিরতি চলছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা থেকে চিকিৎসকরা বন্ধ রেখেছে প্রাইভেট প্রেকটিসও। এ অবস্থায় অচল হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের চিকিৎসা সেবা।
শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, চরম বিপাকে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা। বিশেষ করে ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন।
অনেক রোগী সরকারি হাসপাতাল ছাড়লেও সিট সংকটের কারণে প্রাইভেট হাসপাতালেও ভর্তি হয়ে সেবা নিতে পারছেন না। ফলে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালে কাতরাতে হচ্ছে তাদের। আর্থিকভাবে সচ্ছল রোগীরা চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা যেতে পারলেও অসহায় হয়ে পড়ছে দরিদ্র রোগীরা।
তবে সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে জরুরি সেবা চালু রয়েছে তাদের।
তথ্য বলছে, গেল মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সিসিইউতে মারা যান আবদুল আজিজ নামের এক রোগী। তিনি শহরের নুনিয়ারছড়া এলাকার বাসিন্দা। চিকিৎসকের অবহেলা আর ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে স্বজনরা সিসিইউত ভাঙচুর ও কর্তব্যরত চিকিৎসক সজীব কাজীকে মারধর করেন।
বর্তমানে হামলার শিকার চিকিৎসক চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনার প্রতিবাদ ও হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে কমপ্লিট শাটডাউনে যান সরকারি হাসপাতালের সব চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীরা। বৃহস্পতিবার আন্দোলনে যোগ দেন মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীরা। এক প্রতিবাদ সভায় আন্দোলনে সমর্থন জানাতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ রাখার আহ্বান জানান আন্দোলনকারীরা।
এ অবস্থায় কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে কক্সবাজারে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। তবে জেলা সদর হাসপাতালে জরুরি সেবা চালু রাখলেও সেবা নিতে আসা রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে না। শুধু আগে থেকে ভর্তি থাকা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে নার্সরা। সেবা না পেয়ে ভর্তি থাকা অনেক রোগী অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালে সিট না থাকায় সেখানেও যেতে পারছেন না তারা।
এক প্রকার অসহায় হয়ে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন তারা। তবে ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছেন শিশু, প্রসূতি এবং ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীরা। এতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজারে ইতোমধ্যে ৬ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ৫৮৫ জন এবং স্থানীয় রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৭৮৫ জন। এ পর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত সবাই রোহিঙ্গা নাগরিক। কিন্তু চিকিৎসক, নার্সদের আন্দোলনের কারণে গত তিনদিন ধরে সরকারি ও বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই ডেঙ্গু ও অন্যান্য রোগীরা পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
রফিক উল্লাহ নামে ডেঙ্গু রোগীর এক অভিভাবক বলেন, গত পাঁচ দিন ধরে বাবাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে আছি। আজ তিন দিন ধরে কোনো ডাক্তার বাবাকে দেখতে আসেননি। যখন জানতে পারলাম ডাক্তারদের আন্দোলন চলছে তখন প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মন স্থির করি। কিন্তু রোগীর চাপ এত বেশি যে সেখানেও কোনো সিট খালি নেই। তাই অনেকটা অসহায় হয়ে হাসপাতালে বসে আছি।
রুবিনা ইয়াছমিন নামে এক শিশু রোগীর মা বলেন, ডাক্তার না আসলেও অন্তত নার্সকে দেখাতে পারি। এটিই ভরসা। না হলে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবো?
শুধু তারা নয়, বিনা চিকিৎসায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কাতরাচ্ছে ভর্তি থাকা হাজার হাজার রোগী। এতে মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আসিফ আহমদ হাওলাদার বলেন, আন্দোলনের কারণে ডেঙ্গু রোগীসহ অন্যান্য রোগীও পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পাচ্ছে না। দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মানবিক বিপর্যয়ের আগে এটি সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি হাসপাতালের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেন, শহরের বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে সিট খালি না থাকায় রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।
জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মং টিং ঞো বলেন, চিকিৎসক-নার্স এবং হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করবে না বলে আমাদের জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি চিকিৎসকদের দাবি পূরণ করে হাসপাতালের স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন কালবেলাকে জানান, সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জনসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে তিনি বৈঠক করেছেন। তারা চিকিৎসক ও নার্সদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করেছেন। ইতোমধ্যে পুলিশের পাশাপাশি আনসার সদস্যদের একটি টিমও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আশা করছি সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন