বশির হোসেন
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:১৮ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দলবাজি আর বদলি বাণিজ্যে বিপর্যস্ত খুলনার স্বাস্থ্য প্রশাসন

অভিযুক্ত ডা. মঞ্জুরুল মুর্শিদ (বামে) ও ফরিদ আহমেদ মোল্যা (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত
অভিযুক্ত ডা. মঞ্জুরুল মুর্শিদ (বামে) ও ফরিদ আহমেদ মোল্যা (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের চাহিদার ভিত্তিতে একেরপর এক সংযুক্ত বদলি করে হাসপাতালগুলোতে অচলাবস্থা তৈরির অভিযোগ উঠেছে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মঞ্জুরুল মুর্শিদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ উঠেছে বিভাগের সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেছেন ভয়ংকর এক সিন্ডিকেট। স্টেনোগ্রফার ফরিদ আহমেদ মোল্যা তার এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা। বঙ্গবন্ধু পরিষদ খুলনার এই নেতার আত্মীকরণ বদলি বাণিজ্য শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও চলছে বহাল তবিয়তে।

খুলনার বিভিন্ন হাসপাতালের একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মঞ্জুরুল মুর্শিদের এই সিন্ডিকেটের অন্যতম মূল হোতা ফরিদ আহম্মেদ মোল্যা, স্টোনোগ্রাফার পদে, বিভাগীয় স্বাস্থ্য অফিসে কর্মরত থাকলেও তাকে সবাই পিএ ফরিদ নামে চেনে।

জানা যায়, বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার বারাশিয়া গ্রামের ফরিদ বেপরওয়া হয়ে ওঠেন ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। শেখ হাসিনার চাচাত ভাই সাবেক এমপি শেখ হেলাল এর নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় তার প্রভাবে আধিপত্য বিস্তার করে রাখে খুলনার পুরো স্বাস্থ্য প্রশাসন। অপ্রদর্শিত আয়, মানি লন্ডারিং, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ দুদকের একাধিক মামলায় স্ত্রীসহ কারাবাস করলেও বারবার ফিরে আসেন মুর্শিদের আস্তানায়।

ফরিদের ভায়রা স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে চাকরি নেন বাগেরহাটে। সেখান থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে পদোন্নতি দিয়ে স্টুয়ার্ট হিসেবে পদায়ন করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আওয়ামীপন্থি ঠিকাদারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে রোগীদের খাবার জালিয়াতির একাধিক অভিযোগ হাবিবের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের একাধিক পরিচালক বিভিন্ন সময় হাবিবকে কারণ দর্শানো নোটিশ ও ব্যবস্থা নিতে চাইলেও ফরিদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সম্ভব হয়নি। ভায়রা ফরিদের মাধ্যমে প্রতি মাসের মাশোয়ারা জমা হয় মুর্শিদের কাছে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদ খুলনার জেলার সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে চাকরি দিয়েছেন আত্মীয় নাজমুল হোসেনকে খুলনার পোর্ট হেলথ অফিসে। ২০ গ্রেডে চাকরি নিয়ে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন অফিস সহকারী। কিন্তু বছরের পর বছর ঐ অফিসে প্রধান সহকারী খালি থাকার পরও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক মঞ্জুরুল মুর্শিদের আশীর্বাদে কাউকে পদায়ন করা হয় না সেখানে। নাজমুলই অফিসের সব দায়িত্ব পালন করেন। শিপিং এজেন্টদের বিভিন্ন সার্টিফিকেটের বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভাগ দেয় আত্মীয় ফরিদকে। ফরিদের বোনের ছেলে রাকিবুল ইসলাম আজিমকে পিয়ন পদে চাকরি দিলেও ফরিদের আশীর্বাদে এখন তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী। মেডিকেল কলেজে ফরিদের এজেন্ট রাকিবুল নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন মানুষের কাছে টাকা নিয়ে নিয়োগ দিতে না পেরে পালিয়ে বেড়ালেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কোনো অধ্যক্ষ।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের অন্যতম মুরিদ খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান সহকারী মো. সাইদ। নিজের খেয়াল খুশিমতো বদলান উপজেলা স্বাস্থ্য কমকর্তাদের।

সাবেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা যারা পূর্বে বটিয়াঘাটায় দায়িত্বে ছিলেন তারা কালবেলাকে বলেন, বটিয়াঘাটায় কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা চাকরি করতে হলে তাকে সাইদের সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলতে হয়। এর আগে ডা. অপর্ণাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পদ ছাড়তে হয় সাইদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে।

সেখানকার বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, আমি গত দুই বছর এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা দিয়েছি। দৃশ্যমান ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। সরকারের কাছে স্বীকৃতিও পেয়েছি। এখানে একটাই প্রতিবন্ধকতা, সেটি হলো সাইদ। দুর্নীতির এমন কোনো খাত নেই যার সঙ্গে এই সাইদ জড়িত ছিল না। ১৬ গ্রেডে চাকরি করে সাইদ গড়ে তুলেছে বিপুল সম্পদ।

কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, উপজেলার হোগলাডাঙ্গা নিজখামার এলাকায় ৪ তলা বাড়ি রয়েছে সাইদের। এ ছাড়া সাতক্ষীরা শহরে টেক্সটাইল মিলস সংলগ্ন এলাকায় ৩ তলা বাড়ি ও গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। অথচ নিজে খুলনা নগরীর সিএন্ডবি আবাসিক এলাকায় একটি সরকারি বাড়ি অন্যের নামে বরাদ্দ নিয়ে থাকেন।

মুর্শিদের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহাতাব। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি। ২০ গ্রেডের একজন কর্মচারী থেকে হয়েছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মন্ত্রণালয়ের একাধিক তদন্তে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় তাকে। মন্ত্রণালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে আদালতে রিট করে বারবার এই পদে রয়েছেন বহাল তবিয়তে। নিজের স্ত্রীকে চাকরি দিয়ে বানিয়েছেন একই দপ্তরের প্রধান সহকারী।

জাহাতাবের শ্যালক জাকির হোসেন মালি হিসেবে চাকরি নিলেও নিয়োগ বিধি ভঙ্গ করে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছেন উচ্চমান সহকারী। জাহাতাব এবং ফরিদের অন্যতম সহযোগী খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অফিসের প্রধান সহকারী মো. মাসুম বিল্লাহ। চাকরি নিয়েছেন মেডিকেল সাবডিপোর প্যাকার (প্যাকেজিং কর্মচারী) পদে। ২০ গ্রেডের এই চাকরি থেকে ফরিদ আর জাহাতাবের আশীর্বাদে তিনি এখন প্রধান সহকারী। খুলনা বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বদলি করায় মাসুমকে শাস্তিমূলক বদলি করা হলেও বর্তমান পরিচালক মুর্শিদের সিন্ডিকেটে আবারও তাকে যুক্ত করা হয়।

২০২২ সালের শুরু থেকে খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরে পরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে একে একে এই দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের আবারও চলে আসেন এই দপ্তরে। গড়ে তোলেন অসাধু সিন্ডিকেট। সম্প্রতি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সোহেল নামে এক কর্মচারীর কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে নিয়মবহির্ভূত পদোন্নতি দিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পদায়ন এখন ওপেন সিক্রেট।

কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, সোহেলের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে ফরিদের মাধ্যমে এই বদলি করা হয়। কিন্তু খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এপিপি (বার্ষিক ক্রয়) পরিকল্পনা পক্রিয়াধীন থাকায় অভিজ্ঞতাহীন নতুন লোক নিতে সময় ক্ষেপণ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময় সোহেল এসে উপপরিচালককে হুমকি দিলে তার ক্ষমতা সম্পর্কে অনুসন্ধান করে বেরিয়ে আসে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক দপ্তরের এক মুর্শিদ ও তার মুরিদদের স্বাস্থ্য সিন্ডিকেটের ভয়াবহ এ চিত্র।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী ফরিদ মোল্যা বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতি সরাসরি না করলেও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। দুদক আমার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে মামলা দায়ের করেছে। আমি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মঞ্জুরুল মুর্শিদ বলেন, বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে অনৈতিক সংযুক্তি অর্ডার করেছি অস্বীকার করব না। এ ছাড়া তিনি কোনো আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন বলে দাবি করেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মাভাবিপ্রবির নতুন উপাচার্য ঢাবি অধ্যাপক আনোয়ারুল আজীম

শাবিপ্রবির নতুন ভিসি অধ্যাপক ড. এ এম সারওয়ারউদ্দিন চৌধুরী

নরসিংদীর ‘আটগ্রাম ক্রিকেট টুর্নামেন্ট’ এর ফাইনাল খেলা ২১ সেপ্টেম্বর

কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভিসি ঢাবি অধ্যাপক

ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন ছাড়তে আলটিমেটাম দেবে জাতিসংঘ

জাবি নতুন দুই প্রোভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগ 

অনুমতি ছাড়া ঢাবি প্রশাসনের কারও নাম ব্যবহার না করার আহ্বান

নিয়মিত প্রাইভেট কারে গাঁজা পাচার করে তারা

এক্সিকিউটিভ পদে নিয়োগ দিচ্ছে ভিভো

‘জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গণমানুষের কল্যাণ’

১০

নতুন ভিসি পেল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

১১

‘তুমি না আমার বিরুদ্ধে নিউজ করছো’

১২

আন্দোলনে ২ হাজার মানুষকে খুন করেছে হাসিনা : মির্জা ফখরুল

১৩

চবির নতুন ভিসি অধ্যাপক ইয়াহইয়া

১৪

জবির নতুন ভিসি ড. মুহাম্মদ রেজাউল

১৫

যেভাবে দেখবেন শান্ত-রোহিতদের লড়াই

১৬

আদালতে যা বললেন বিচারপতি মানিক

১৭

পুলিশ সদস্যের সঙ্গে ‘পালাল’ রোহিঙ্গা কিশোরী

১৮

দুবাই থেকে চট্টগ্রামে ঋণখেলাপি স্বামী-স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ

১৯

কলাপাড়ায় ৭ দফা দাবিতে মানববন্ধন

২০
X