ফেনীতে গত ২৪ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ফেনী জেনারেল হাসপাতালের ডায়ালাইসিস বিভাগ। ফলে কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের প্রতি সপ্তাহে ২-৩ বার বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এতে করে রোগী ও স্বজনদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
ফেনীতে জেনারেল হাসপাতালে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার কিছু অংশের মানুষ এ সেবা নিয়ে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে বিভাগটি বন্ধ থাকায় রোগীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ডায়ালাইসিস বিভাগ চালু করার দাবি জানিয়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২১ আগস্ট পাহাড়ি ঢলে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ফেনী জেনারেল হাসপাতাল বন্যায় আক্রান্ত হয়। ওই সময় হাসপাতালের পুরাতন ভবনের নিচতলায় ডায়ালাইসিস বিভাগ পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর থেকে ওই বিভাগের সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
জানা যায়, প্রতি মাসে ৭০-৮০জন রোগী ডায়ালাইসিস সেবা নেয়। এসব রোগীদের কমপক্ষে প্রতিসপ্তাহে ২-৩ বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রতিদিন ১০ জন নার্স তিন শিফটে ৩০ জনকে এ সেবা প্রদান করেন। এছাড়াও ৩০০-৪০০জন রোগী ডায়ালাইসিস সেবা পেতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। তারাও অপেক্ষমান রয়েছেন।
রোগীরা জানান, ফেনী জেনারেল হাসপাতালে কিডনি রোগীরা ছয় মাসের প্যাকেজে সরকারি ফি ২২ হাজার টাকা জমা দিয়ে এ সেবা পেয়ে থাকেন। এসব রোগীরা প্রতি সপ্তাহে দুই বার করে মাসে আটবার ডায়ালাইসিস করে থাকেন। এছাড়াও তারা প্রতিবার আনুষাঙ্গিক ব্যয় করতে হয় ৪৫০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ থাকায় বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে রোগীদের ছোটাছুটি করতে হয়। প্রতিবারই ডায়ালাইসিস করতে কিডনী রোগীদের গুনতে হচ্ছে ২৫০০-৩০০০ টাকা। এতে করে কিডনী রোগীরা বর্তমানে বিপাকে পড়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বাইরের হাসপাতালে টিকিৎসা নিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানিতে পড়তে হয় রোগী ও স্বজনদের। নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করতে না পারায় রোগী ও স্বজনদের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা দুশ্চিন্তা। এরমধ্যে অনেকে অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস করতে না পারায় বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগছেন। এ প্রেক্ষিতে তারা ফেনীতে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রামে গিয়েও কিডনি রোগীদের সেবা নিতে হচ্ছে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা নার্গিস আক্তার জানান, তার স্বামী কবির আহমদ গত তিন বছর ধরে কিডনী রোগে আক্রান্ত। প্রতি মাসে তাকে আটবার ডায়ালাইসিস দিতে হয়। বন্যার জন্য গত দুইসপ্তাহে চারবার ডায়ালাইসিস দিতে পারেননি। তিনি জানান, বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে অনেক টাকা খরচ হয়। প্রতিবারই ২৫০০-৩০০০ টাকা গুনতে হয়।
অপর রোগী ফেনী শহরের ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা পারভীন আক্তার। তিনি জানান, গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত। ফেনী জেনারের হাসপাতাল বন্ধ থাকায় বেসরকারিভাবে ডায়ালাইসিস দিতে অনেক কষ্ট হয়। হাসপাতালে আসা-যাওয়া হয়রানি হতে হচ্ছে রোগীদের।
ছাগলনাইয়া উপজেলার নতুন করৈয়া বাজার এলাকার কিডনি রোগে মারা যাওয়া তোফায়েল আহম্মদের ছোট ভাই তোফাজ্জেল হোসেন ফাহিম জানান, তার ভাই বন্যার কারনে ও হাসপাতালের ডায়ালাইসিস বিভাগ চালু না থাকায় চিকিৎসা সেবা দিতে পারেননি। ভাইকে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আর কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহসায় উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেন তিনি।
পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা কিডনী রোগে মারা যাওয়া সুলতানা আক্তার মুন্নি’র (৩৫) স্বামী মো. রবিন জানান, এ রোগে তার স্ত্রী গত ২-৩ বছর ধরে আক্রান্ত। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করায় রোগী সুস্থ ছিল। কিন্তু এবার সময়মতো ডায়ালাইসিস করাতে না পারায় তাকে আর বাঁচানো যায়নি। কিভাবে সন্তানাদি নিয়ে বাঁচবো কিছু বুঝতেছি না।
নিয়মিত ডায়ালাইসিস নেয়া রোগী মো. শিপলু জানান, ফেনী জেনারেল হাসপাতালে গেলে কবে থেকে ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু হবে, কেউ বলতে পারে না। প্রতিদিন গিয়ে ফেরত আসতে হয় রোগীদের।
তিনি জানান, সরকারি ফি দিয়ে ডায়ালাইসিস ইউনিটে ভর্তি হলেও এখন প্রতিবার বেসরকারিভাবে চিকিৎসা নিতে গুনতে হচ্ছে অনেক টাকা। এ ব্যয়ভার কে নিবে, এর কোন সদুত্তর নেই।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. আসিফ ইকবাল জানান, বন্যার ফলে হাসপাতালের ডায়ালাইসিস ইউনিট বন্ধ রয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানানোর পরও কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি। তাই রোগীদের সেবার কথা চিন্তা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ইউনিট পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা করা হয়েছে। রোগীদের সিটগুলোও মেরামত করা হচ্ছে। এছাড়া ঢাকা থেকে টেকনিশিয়ান এসে ডায়ালাইজার মেশিনগুলো বসানো প্রয়োজনীয় কাজগুলো অল্পসময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে।
তিনি জানান, বন্যা উত্তর পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে রোগীদের প্রচুর ভিড় দেখা দিয়েছে। রোগীদের চাপে চিকিৎসা দিতে ডাক্তার ও নার্সদের নিয়মিত হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি মানুষ।
আরএমও জানান, গত ২৪ ঘন্টায় হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১৮ বেডের বিপরীতে ১২৫ জন রোগী, শিশু ওয়ার্ডে ২৬ বেডের বিপরীতে ১০৮ জন রোগী, হাসপাতালে ২৫০ বেডের বিপরীতে ৫৭৩ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। এছাড়া সাপের দংশনে আক্রান্ত ১০জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজী জানান, আগামী ৭-১০ দিনের মধ্যে ডায়ালাইসিস বিভাগ চালু করা হবে। এরপর পুরোদমে রোগীরা সেবা নিতে পারবে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে রোগীদের ভোগান্তি অনেকটা লাঘব হবে।
মন্তব্য করুন