রাশিয়া থেকে পরিচালিত হচ্ছে অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস। তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ব্যবহার করে প্রত্যেক এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র বলছে, রেডি অ্যাপস ও ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসের যুগলবন্দিতে দীর্ঘদিন এমনই ভয়াবহ কর্মকাণ্ড চলছে পুরো মেহেরপুরজুড়ে। ওই দুই অ্যাপসই রাশিয়ার তৈরি। এর মধ্যে রেডি অ্যাপস রাশিয়া থেকে আর ম্যানেজমেন্ট অ্যাপস আর্থিক লেনদেনের জন্য বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত হয়। তবে ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসটি রাশিয়া থেকে পরিচালিত রেডি অ্যাপসের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো কার্য সমাধান করতে পারে না। ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ মূলত বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এজেন্ট সিম ব্যবহার করে মেইন সাইট, এজেন্ট ও জুয়াড়িদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
মূলত ওয়ান এক্স বেট, মেলবেট, মোস্ট বেট, টি টোয়েন্টি বেট ও টোয়েন্টি ফোর বেট অনলাইন জুয়ার সাইটগুলোর এজেন্ট ডিলারশিপ হিসেবে ভূমিকা রাখে রেডি অ্যাপ। অ্যাপটির অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ও ডেক্সটপ বান্ধব।
অনলাইন জুয়া যেন এক গোলক ধাঁধা। অনলাইন জুয়া খেলায় যারা জড়িত তারা দিনে দিনে অধঃপতিত হচ্ছেন আর্থিক ও সামাজিকভাবে। দেশীয় মুদ্রা পাচার হচ্ছে বিদেশে। মাঝ থেকে লাভবান হচ্ছেন শুধুমাত্র অনলাইন জুয়ার সুপার এজেন্ট, মাস্টার এজেন্ট, সাব এজেন্ট ও তাদের ম্যানেজাররা। মেহেরপুর জেলাতে প্রায়শই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে মাস্টার এজেন্ট ও সাব এজেন্টরা আটক হচ্ছেন। তাদের নামে মামলাও হচ্ছে। তবে যথোপযুক্ত আইন না থাকাতে আটকরা অনায়াসে জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন। পূর্ণ উদ্যমে আবারো দেশীয় মুদ্রা পাচার করছেন বিদেশে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে পুলিশের পক্ষে সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনের কোনো ধারাতে মামলা করা সম্ভব নয়। এজন্য পুলিশ এজেন্টদের হাতেনাতে গ্রেপ্তার করার পর আইসিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের করছেন এবং সিআইডি বরাবর মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করার জন্য আবেদন করে থাকেন। সিআইডি তদন্তের দীর্ঘ সূত্রিতার সুযোগ নিয়ে এক সময় অনলাইন জুয়ার এজেন্টরা চলে যান দেশের বাইরে। ফলে তারা রয়ে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর দেশের মধ্যে তাদের ম্যানেজার ও সাব এজেন্ট নতুন উদ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকেন।
কালবেলা অনলাইন ধারাবাহিকভাবে মেহেরপুরের অনলাইন জুয়া সম্পর্কিত নিউজ শুরুর পর ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীরা যোগাযোগ শুরু করেন। যোগাযোগ করেন তাদের একজন। যিনি ছিলেন সাব এজেন্ট। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যিনি এখন নিঃস্ব প্রায়। তার দেওয়া তথ্যেই এসব ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।
রেডি অ্যাপসের সাবেক এক এজেন্ট কালবেলাকে জানান, কীভাবে বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে রেডি অ্যাপসে সংযুক্ত হতে হয় এবং ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করতে হয়।
তিনি ম্যনেজমেন্ট অ্যাপের মাধ্যমে নগদ ও বিকাশের এজেন্ট সিমের টাকা কীভাবে জুয়াতে ব্যবহার করা হয়, তার একটি ভিডিও ক্লিপ কালবেলাকে সরবরাহ করেন।
ভুক্তভোগী ওই সাব এজেন্ট জানান, আগে সরাসরি রেডি অ্যাপসের এজেন্ট দেওয়া হলেও এখন আর কাউকে নতুন এজেন্ট দেওয়া হয় না। তবে মাস্টার এজেন্টদের রেফারেন্সের ভিত্তিতে নতুনদের ম্যানেজমেন্ট অ্যাপসের পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া এজেন্ট নিয়োগ সম্পূর্ণ হলে ৮ জন করে গ্রুপ করে দেওয়া হয়। তারা হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম গ্রুপে সংযুক্ত থাকে। প্রতি এজেন্ট প্রত্যেক বার অ্যাপে সংযুক্ত হতে গেলে গ্রুপের মাধ্যমে নতুন পিন নম্বরের নোটিফিকেশন আসে। কখনো আইনশৃংখলা বাহিনী এজেন্টকে আটক করতে আসলে গ্রুপে নোটিফিকেশন দেওয়া মাত্র গ্রুপের সমস্ত তথ্য মুছে ফেলা হয়।
সূত্র জানিয়েছে, ম্যানেজমেন্ট অ্যাপের মেইন চ্যানেল নগদ। এ ছাড়াও সেকেন্ডারি চ্যানেল হিসেবে রয়েছে বিকাশ, রকেট, উপায় ও ট্রাস্ট এজিয়াটা। এগুলোর যে কোনো একটি বেছে নিলে সেখানে একটি এজেন্ট নম্বর দেখায় যেখানে ন্যূনতম ৫০০ টাকা দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে ই-ওয়ালেট যুক্ত হয়ে যায়। এই ব্যালেন্স দিয়ে তিনি পরবর্তীতে জুয়া খেলতে পারেন। প্রতিটি এজেন্ট অনলাইন জুয়ার প্রতি ডিপোজিটে ৯ শতাংশ ও প্রতি উইথড্রতে ৬ শতাংশ কমিশন পান। সে হিসাবে কোনো এজেন্ট একটি এজেন্ট সিম দিয়ে এক দিনে ১০ লাখ টাকা ডিপোজিট ও ১০ লাখ টাকা উইথড্রো করাতে পারলে বিনা পুঁজিতেই তার কমিশন দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর এজেন্টরা আর্থিক লেনদেনের জন্য মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসের এজেন্ট সিম ভাড়ায় নিয়ে থাকে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে। এজন্য মাঝে মধ্যে এজেন্ট সিমের মালিক ধরা পড়লেও প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
ইতোপূর্বে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছিলেন, মূলত অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সঠিক আইন না থাকাতে আটকরা সব সময় প্রবেশনে মুক্তি পেয়ে যান। এজন্য জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে এক সময় অনলাইন জুয়াড়িদের ধরতে যথেষ্ট অভিযান পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে অভিযানের গতি মন্থর হয়ে যায়।
অপর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনলাইন জুয়াটা আসলে কী এবং কীভাবে পরিচালিত হয়- আর্থিক লেনদেনই বা কীভাবে হয়, সেটা আদালতে প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য। অনেকটা রূপকথার গল্পের মতই লাগে আদালতের কাছে। এ কারণে অনেক সময় আদালতে পুলিশ বাদী মামলার কর্মকর্তাকে তিরস্কারের সম্মুখীন হতে হয়। এসব বিষয় বিবেচনাতে নিয়েই অনলাইন জুয়া এজেন্টদের আটকের অভিযানে অনেকটাই মন্থর গতি চলে এসেছে।
এ বিষয়গুলো নিয়েও কালবেলার পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে পূর্বের গ্রেপ্তাকৃত কয়েকজন এজেন্টের মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাদেরকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন এবং প্রতারণার কয়েকটি ধারাতে মামলা দেওয়া হয়েছে। অথচ যেখানে বলা হচ্ছে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে- সেখানে মামলায় মানি লন্ডারিং আইনের কোনো ধারা সংযুক্ত করা হয়নি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে মেহেরপুর জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এসআই মনির কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের বিদ্যমান আইনে পুলিশের পক্ষে সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনের ধারাতে মামলা করা সম্ভব নয়। এজন্য পুলিশ এজেন্টের হাতে নাতে গ্রেপ্তার করার পরও আইসিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের করেন।
‘ইতোমধ্যে আমরা মানি লন্ডারিং আইনে ৯ জন শীর্ষ এজেন্টের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছি। এরপর সিআইডি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেই সেটি মানি লন্ডারিং মামলায় রূপান্তরিত হবে। তবে সিআইডির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে কি না সেটা আমার জানা নাই।’
উল্লেখ্য, ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। প্রায় ২৩০টি সাইটের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে গত আড়াই বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে টাকা পাচার হয়েছে বলে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি।
মন্তব্য করুন