কথা ছিল প্রবাসে থাকা অসুস্থ বাবা তাকে বিদেশ নিয়ে নিজে ফিরবেন দেশে। রোগাক্রান্ত শরীরে প্রবাসে আর কাজ করতে পারছেন না। বড় ছেলে হিসেবে বিদেশ গিয়ে পরিবারের হাল ধরবেন মাসুদ- ছিল এমনই আশা।
পরিবারের সেই আশা রয়ে গেল অধরাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ৪ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ফেনী সরকারি কলেজের বিএসএস প্রথম বর্ষের ছাত্র মো. সরোয়ার জাহান মাসুদ।
ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর জয়লস্কর মীর বাড়িতে ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর জন্ম হয় মাসুদের। ২০২০ সালে স্থানীয় সিলোনিয়া হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ২০২২ সালে দাগনভূঞা সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ফেনী সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ বড়। মেজ ভাই মাসুম আল সামির সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ও ছোট ভাই সাইম সুলতান পড়ছে মাদ্রাসায়। বাবা শাহজাহান টিপু দুবাই প্রবাসী। মা বিবি কুলসুম একজন গৃহিণী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই মাসুদ ও তার ছোট ভাই সামির সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঘটনার দিন ৪ আগস্টও সকাল থেকে তারা দুই ভাই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে অবস্থান নেন। দুপুর আনুমানিক ২টার দিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত চারদিক ঘেরাও করে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি করতে থাকে। দুইটি গুলি এসে লাগে মাসুদের বুকে, একটি হাতে।
তার ছোট ভাইসহ কয়েকজন মিলে তাৎক্ষণিক মাসুদকে উদ্ধার করে দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু পথিমধ্যে দাগনভূঞার বেকের বাজারে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের গতিরোধ করে। খবর পেয়ে তাদের উদ্ধারে বাড়ি থেকে তার আত্মীয়-স্বজনরা এলে তাদেরও মারধর করা হয়। একপর্যায়ে মাসুদকে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হাসপাতাল থেকে লাশ বাড়ি নিতে গেলেও দেওয়া হয় বাধা। পরে রাত ১টায় পরিবারের কাছে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। এবং রাতের মধ্যেই লাশ দাফন করতে বলা হয়। না হয় লাশ নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুর রশিদ মিলন।
এ ঘটনায় মাসুদের মা বিবি কুলসুম ফেনী-২ সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে প্রধান আসামি করে ১৩৪ জনের নামোল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০০ জনের বিরুদ্ধে দাগনভূঞা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
সন্তানের কথা মনে করে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন মা। তার ছবি, ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও অন্যান্য জিনিস বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
মাসুদের ফুফাত ভাই মো. মোশারফ হোসেন জানান, গুলিবিদ্ধ মাসুদকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের লোকজন বাধা দেয়। প্রত্যেকের মোবাইলে ফেসবুক প্রোফাইল লাল কিনা চেক করা হয়।
মাসুদের ছোট ভাই মাসুম আল সামির জানান, ছাত্রলীগরা তার বড় ভাই মাসুদকে গুলি করে হত্যা করেছে।
মাসুদের মা বিবি কুলসুম বলেন, কোটাতো রয়ে গেল, কেন আমার বুকে ধনকে তারা মেরে ফেলল। মেধাবীদের কেন মারল তারা। আমার ছেলেতো কারো ক্ষতি করে নাই। সে অনেক ভালো মানুষ ছিল। শুধু পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ত, রমজান মাসে ২০ রোজার পর মসজিদে চলে যেত। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।