নওগাঁর পোরশায় ছয় কৃষকের জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে তৌফিক শাহ নামে বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে। দেশের পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতার জোরে তিনি ওই ছয় কৃষকের ২৪ বিঘা জমি দখল করেছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
তাই প্রতিকার পেতে ওই ছয় কৃষক পৃথকভাবে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ ওঠা ওই নেতা পোরশা উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি।
ভুক্তভোগী কৃষকদের দাবি, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিএনপি নেতা তৌফিক শাহ জোর করে তাদের জমি দখল করে নিয়েছেন। অথচ আমরা কেউ দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই।
আর বিএনপি নেতা তৌফিক শাহর দাবি, জমিগুলো তার। বরং ১৫ বছর আগে ক্ষমতার জোরে তারাই দখলে নিয়েছিলেন। তার পরও তিনি জমিগুলো দখল করেননি।
ছয় কৃষকের করা লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পোরশা মিনাবাজার এলাকার বাসিন্দা সাব্বির হামজা চৌধুরী নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে তেঁতুলিয়া মঠবাড়ী গ্রামের কৃষক দুর্জয় মণ্ডল, গোপালপুর গ্রামের মোকলেসুর রহমান, মাহতাব কাজী, সলেমান ও খায়রুল ইসলাম এবং পোরশা কাঠপুকুর গ্রামের রবি চাষাবাদ করে আসছেন। ওই ছয় কৃষকের বর্গা নেওয়া জমির মোট পরিমাণ ২৪ বিঘা। চলতি আমন মৌসুমে তারা সেই জমিতে ধান আবাদ করেছেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতা তৌফিক শাহ ও তার অনুসারীরা দলবদ্ধ হয়ে ওই ছয় কৃষকের জমি দখল করে নেন। এরপর থেকে তারা জমিতে যেতে পারছেন না। এমনকি জমির কাছে গেলে তাদের প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।
তেঁতুলিয়া মঠবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা দুর্জয় মণ্ডল বলেন, পোরশার মিনাবাজার এলাকার বাসিন্দা সাব্বির হামজা চৌধুরীর কাছ থেকে তেঁতুলিয়া মৌজার বাঁশকুড়ি মাঠে ১০ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে পাঁচ বছর ধরে চাষাবাদ করছি। চলতি মৌসুমে ওই ১০ বিঘা জমিতেই ধান আবাদ করেছি।
গত ১৩ আগস্ট সকাল থেকে আমার কয়েকজন শ্রমিক ধানক্ষেতে ঘাস নিড়ানি দিচ্ছিল। সকাল ৯টার দিকে পোরশার তৌফিক শাহ ৩৫-৪০ জন লোক নিয়ে জমিতে এসে শ্রমিকদের সেখান থেকে সরিয়ে দেন। খবর পেয়ে আমি সেখানে গেলে তারা আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করে। দৌড়ে পালিয়ে আমি জীবন রক্ষা করি। এখন তৌফিক শাহ ও তার লোকজন বিভিন্নভাবে আমাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। ওই জমিতে দ্বিতীয়বার গেলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ১০ বিঘা জমিতে ধান আবাদে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন আবাদ করা ধান কেটে ঘরে না তুলতে পারলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমাকে পথে বসতে হবে। থানায় অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত থানা পুলিশ জমির ধান কেটে ঘরে তুলতে পারব কি না, সে ব্যাপারে কোনো আশ্বাস দিতে পারছে না।
দুর্জয় মণ্ডলের মতো গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা মোকলেসুর রহমান একই ব্যক্তির কাছ থেকে উপজেলার তেঁতুলিয়া মৌজার শিবিকান্দর এলাকায় ২ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চার বছর ধরে চাষাবাদ করে আসছেন। মোকলেসুর রহমান বলেন, গত ১০ আগস্ট তৌফিক শাহ লোকজন নিয়ে গিয়ে তাকে হুমকি দিয়ে গেছেন, তিনি যেন ওই জমিতে আর না যান। ওই জমির আশপাশে গেলেও প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলে তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে তিনি জমিতে যেতে পারছেন না।
সাব্বির হামজা চৌধুরী বলেন, আমার দাদার দাদা ইব্রাহিম শাহ মোট ১১০০ বিঘা জমি ওয়াকফ আলাল আওলাদ করে দেন। ওয়াকফ প্রশাসকের আদেশে ২০১৬ সাল থেকে ওইসব ওয়াকফ সম্পত্তির অফিসিয়াল মোতাওয়াল্লি (রক্ষণাবেক্ষণকারী) হিসেবে আমি নিয়োগ পাই। নিয়ম হচ্ছে মোতাওয়াল্লির মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি ভোগদখল করতে হবে। কিন্তু এত দিন কোনো নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে তৌফিক শাহ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কিছু লোক ওইসব ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করে আসছিলেন। অফিসিয়ালি মোতাওয়াল্লি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে জমির দখল বুঝে নিতে গেলে তৌফিক শাহর নির্দেশে আমাদের ওপর একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে হামলায় একজন কৃষকের মৃত্যুও হয়। এসব ঘটনায় একাধিক মামলা চলমান।
তিনি আরও বলেন, বৈধ মোতাওয়াল্লি হওয়ার পরও আমি এখনো ওয়াকফ করা সব সম্পত্তি বুঝে পাইনি। তৌফিক শাহ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা এখনো অবৈধভাবে জমি দখল করে আছেন। আংশিক যেটুকু জমি আমার দখলে ছিল ৫ আগস্টের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেই জমিগুলোও দখল করে নেওয়া হচ্ছে।
ছয় বর্গাচাষির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গত সোমবার রাত ৮টার দিকে তৌফিক শাহ কালবেলাকে বলেন, ওই জমিগুলোর প্রকৃত মালিক আমি। আমার কাগজপত্র সব আছে। ১৫ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের লোকজন আমার বেশকিছু জমি দখল করে নেয়। একের পর এক মামলা দিয়ে এত দিন অন্যায়ভাবে তারা আমার জমি দখল করে আসছিল।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই দখলকারীরা সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। আমি কোনো জমি দখল করতে যাইনি। এ ছাড়া দলীয়ভাবে আমাকে হেয় করার জন্য আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোজ্জাম্মেল শাহ চৌধুরীর ইন্ধনে ওই ছয় কৃষক আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরের দিকে জানতে চাইলে পোরশা উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোজাম্মেল শাহ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, দলীয় পরিচয়ে যারা দখলবাজি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। জমি দখল বা অন্য যে কোনো ধরনের অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দলের হাইকমান্ডের কাছে আমার সুপারিশ থাকবে।
ইন্ধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কারা কারা এলাকায় দখলসহ অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং ইন্ধনদাতা কে—আপনি পুলিশ প্রশাসনের কাছে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।
বিএনপির এই নেতা জোর দিয়ে আরও বলেন, তৌফিক শাহ বিএনপি করার জন্য কোনো মামলা খায়নি। তিনি শুধু জমি দখল করার জন্য মামলা খেয়েছেন। তিনি দখলবাজ। তার জন্য আমাদের বিএনপির দুর্নাম হচ্ছে। আমি হাজার হাজার লোকের সামনে এ কথা বলতে পারব। তার বিরুদ্ধে এখনো অনেক অভিযোগ আছে বলেও জানান বিএনপির এই নেতা।
জানতে চাইলে পোরশা থানার ওসি আতিয়ার রহমান কালবেলাকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর জমি-সংক্রান্তসহ বিভিন্ন অভিযোগ পেয়েছি। আমাদের জমি-সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু করণীয় নেই। এ ছাড়া জমি দখল করে দেওয়া পুলিশের কাজ না। তাই আমরা ভুক্তভোগীদের ডেকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে বলছি। আর যেগুলো সমাধান করা যাচ্ছে, সেগুলো সমাধান করে দিচ্ছি।
মন্তব্য করুন