ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হলেও দাগনভূঞা ও ফেনী সদরের কিছু এলাকায় বন্যা যেন জেঁকে বসেছে। অতিবৃষ্টি আর ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত ১৯ আগস্ট মুহুরী ও কহুয়া নদীর বাঁধ ভেঙে শুরুতে পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়। এরপর স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় বলতে গেলে পুরো জেলায়ই পানিতে তলিয়ে যায়। গত কয়েকদিন থেকে বন্যা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হতে থাকে।
জেলার ছয়টি উপজেলার মধ্যে ফেনী সদরের শর্শদি ও পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন এবং দাগনভূঞার পূর্বচন্দ্রপুর, রাজাপুর, সিন্দুরপুর, জায়লস্কর ও সদর ইউনিয়নের কিছু এলাকা ছাড়া আর কোথাও পানি নেই। এসব এলাকায় বন্যা যেন জেঁকে বসেছে। পানি নামার ধীরগতি মানুষের দুর্ভোগকে করছে দীর্ঘায়িত।
দাগনভূঞার জায়লস্কর ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের মো. হানিফ জানান, তারা ১৩ দিন ধরে পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ঘর থেকে পানি নেমে গেলেও রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা নেই। প্রতিবেশীর বাড়িতে পরিবারের আটজনকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যায় জেলার ১০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিত দেড় লাখ লোকের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার ৬৭৩ জন ঘরে ফিরেছে। বর্তমানে ৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯ হাজার ৩২৭ জন আশ্রিত রয়েছে। বন্যায় জেলায় আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ২৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে জেলা প্রশাসন।
বন্যার্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় ৬৩ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণ করেছে। এ ছাড়াও স্থানীয়ভাবে এবং দেশের অন্যান্য জেলা থেকে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন, বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে।
ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে। স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে। জেলায় সরকারিভাবে পাঁচটি মেডিকেল ক্যাম্প এবং ২২টি মোবাইল টিম চালু রয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর আরও দুটি মিলিটারি ও পাঁচটি সিভিলসহ ২১টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ জেলার সবকটি উপজেলাতেই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে আকস্মিক এ বন্যা। এতে অসংখ্য বসতঘর, গ্রামীণ সড়ক, ফসলি জমি ও ছোট-বড় পুকুর তলিয়ে কৃষি ও মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর খেতে মাচা থাকলেও নেই সবুজ গাছ। পানির নিচ থেকে ভেসে উঠছে হলুদ, আদা, আউশ, আমন ও শীতকালীন আগাম বিভিন্ন সবজি ক্ষেত। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধুমাত্র কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এদিকে বন্যায় জেলার অধিকাংশ পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বন্যায় মৎস্য খাতে রেণু, পোনা, বড় মাছ ও পুকুরের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে জেলার ছয়টি উপজেলায় বন্যায় মাছচাষিদের ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ সংশ্লিষ্ট অন্তত ২০ হাজার মানুষ। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে একক ও যৌথ মালিকানাধীন ১৮ হাজার ৭৬০টি পুকুর-দিঘি। এসব পুকুর থেকে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বড় মাছ এবং ১৯৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে গেছে। এ ছাড়া জেলায় খামারিদের ৫৪ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদকৃত ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ফেনীতে বন্যায় গ্রামীণ জনপদের রাস্তাগুলোতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। সড়ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় গাড়ি চলাচল বন্ধ। মারাত্মক দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ। পাঁচশ কিলোমিটার রাস্তা মেরামতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার বেশি। জেলায় এলজিইডি ও সড়ক বিভাগের আওতাধীন সড়কের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ১৪০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।
ফেনী এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল ফারুক কালবেলাকে জানান, জেলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় ৪ হাজার ৩০০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে পানিতে ডুবেছিল ৩ হাজার ৩০০ কিলোমিটার। পানির স্রোতে ৩৪২টি সড়কে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০০ কিলোমিটার। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে মেরামত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি সড়ক ২ মাসের মধ্যে, আর দীর্ঘমেয়াদি সড়কগুলো পৌনে ২ বছরের মধ্যে মেরামত কাজ সম্পন্ন করবে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তাই বরাদ্দের জন্য অর্থের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে।
ফেনী সড়ক ও জনপদ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী বিনয় কুমার পাল বলেন, আমাদের আওতাধীন কিছু সড়কে এখনো পানি রয়েছে। চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। সরেজমিন ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত পরিমাণ নিরূপণ করা হবে।
উল্লেখ্য, তিন দফা বন্যায় মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর দুপাশে ১২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ৮৯টি স্থানে ভাঙন মেরামত করা না গেলে আবারও বন্যার কবলে পড়বে ফেনীর এ জনপদ। দ্রুততম সময়ে সবকিছু স্বাভাবিক হবে—এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।