২২ বছর আগে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়েছেন বাবা। তার একমাত্র ছেলে দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে গিয়ে হয়েছেন পঙ্গু। বলছি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে ছেলে জুনায়েদ (২৫) এর কথা। অভাব অনটনের সংসারে যেই ছেলেটি ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সেও এখন বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। তবুও সন্তানের বেঁচে ফিরে আসায় সৃষ্টিকর্তার দরবারে শুকরিয়া বাবা-মায়ের।
জানা যায়, জুনায়েদ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে নিজের ও পরিবারের খরচ চালাতেন। অভাব অনটনের সংসারে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় ছেলেকে নিয়ে বড় আশা ছিল বাবা-মায়ের। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ২৫ বছর বয়সে পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে জুনায়েদকে। দেশে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন চলছে তখন ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দেন জুনায়েদ। সেই দিনের ভয়ানক দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিয়েছেন সে।
জুনায়েদ কালবেলাকে বলেন, শুরু থেকেই কোটাসংস্কার আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। সেই কারণে আন্দোলনে যোগ দেই। এরই ধারবাহিকতায় গত ৫ আগস্ট দুপুরে কর্মসূচি অনুযায়ী শাহবাগ ও গণভবন ঘেরাও করার কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য মাদ্রাসার কয়েকজন বন্ধুদের নিয়ে রওনা হই। প্রথমে সাইনবোর্ড এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত যাই। এসময় সেনাবাহিনী ও বিজিবি আমাদের কোনো প্রকার বাঁধা দেয়নি। এরপর সামনে এগিয়ে কাজলায় পৌঁছালে পুলিশ অতর্কিত হামলা চালায়। সেখান থেকে দফায় দফায় হামলার পর যাত্রাবাড়ী থানা পর্যন্ত পৌঁছালে দুপুর প্রায় ২টার সময় গোলাগুলি শুরু হয়। এসময় একটি ভ্যানের পেছনে গিয়ে আশ্রয় নেই। দীর্ঘক্ষণ পালিয়ে থাকার পর বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ আমাদের কাছে চলে আসে। পুলিশের কাছে মাফ চেয়ে পাশের গলি দিয়ে দৌড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গুলি করে। খুব কাছ থেকে আমাকে গুলি করেছে।
তিনি বলেন, আমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হলে আমি পড়ে যাই। দীর্ঘক্ষণ গোলাগুলির পর স্থানীয় লোকজন ও সহকর্মীরা আমাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। সেখান থেকে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যায়। পরে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সেখান থেকে অর্থোপেডিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে জানা যায়, পায়ের দুটো রগ ছিড়ে গিয়েছে। অপারেশন করতে গিয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শে আমার পা কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও পা রাখার কোনো উপায় পায়নি।
জুনায়েদ আরও বলেন- আমরা দেশের জন্য, এই জাতির জন্য যতটুকু সম্ভব করেছি। আমার পা হারিয়েছি। বর্তমান রাষ্ট্র প্রধান আমাদের জন্য কী করবেন তা জানি না। সংসারে আমিই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় টিউশনি করেছি সংসার চালানোর জন্য। তবে যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, তাতে আমরা সবাই আনন্দিত। কিন্তু একটি পা হারানোর ব্যথা- যে হারিয়েছে সেই বোঝে।
জুনায়েদের পিতা হাবিবুর রহমান বলেন, আমার একটি মাত্র ছেলে। এই ছেলেটা (জুনায়েদ) হলো আমার ভরসার জায়গা। খাওয়া-দাওয়াসহ পুরো সংসারটা সে চালাতো। আমি নিজেও অচল। দীর্ঘ ২২ বছর যাবত প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে আছি। কোনো কাজ করতে পারি না। মানুষ সহায়তা করলে আমার সংসার চলে। না হলে না খেয়ে পড়ে থাকতে হয়।
প্রতিবেশী নিয়ামত উল্লাহ বলেন, এই পরিবারটি একবারে অসহায়। আল্লাহপাক জানেন ভবিষ্যতে কী অবস্থাতে তাদের দিন যাবে। জুনায়েদ যেই কর্মে ছিল সেখানে থাকলে হয়ত এই পরিবারটা ঘুরে দাঁড়াতে পারতো। দেশের জন্য সে আন্দোলন করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বিনিময়ে একটি পা হারিয়েছে। বর্তমান দায়িত্বে থাকা সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ জুনায়েদের পরিবারের জন্য এমন কিছু করে দেয় যেন বাকি জীবনটা সুন্দর করে চলতে পারে।
জুনায়েদের সহপাঠী মাহবুব আলম বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে। এই দেশে শান্তি ফিরে এসেছে। জুনায়েদের অচল হয়ে যাওয়া বিবেচনায় রেখে সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবে এমনটাই প্রত্যাশা। একই সঙ্গে এই আন্দোলনে যারা হতাহত হয়েছেন তাদের ওপর আক্রমণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান তিনি।