মেহেরপুরের ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স। সেখানে ছিল স্বাধীনতার ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত এবং উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ৬০০টি ছোট-বড় ভাস্কর্য। বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের সেক্টরভিত্তিক ঘটনাগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল ভাস্কর্যের মাধ্যমে। যেখানে দাঁড়িয়ে স্বচক্ষে দেখা যেত মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের দৃশ্য।
দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জ্ঞান আহরণ ও গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মুজিবনগর কমপ্লেক্স। সেই কমপ্লেক্সের সব ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কমপ্লেক্সজুড়ে চালিয়েছে লুটপাট। এখন শুধু স্মৃতিসৌধ ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই এখানে। ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ইতিহাস। হামলা ও লুটপাটকারীরা প্রমাণ মুছে ফেলতে সব সিসি ক্যামেরা ভেঙে, কন্ট্রোল রুম থেকে হার্ডডিস্ক সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে।
গত ৫ আগস্ট সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর পেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আনন্দ মিছিলে মেতে ওঠে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সুযোগসন্ধানী দুষ্কৃতকারীরা। ওইদিনই সন্ধ্যার পর কয়েক দফা তাণ্ডব চালিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয় মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের স্মারক ভাস্কর্যগুলো।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হয় কালবেলার পক্ষ থেকে। তারা জানান, পুলিশের কর্মবিরতিতে যাওয়ার সুযোগকে কাজে লাগায় দুষ্কৃতকারীরা। তারা বিপুলসংখ্যক এসে সিটি কমপ্লেক্সের গেটে হামলা চালায়। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত আনসার ব্যাটালিয়নের পক্ষ থেকে কয়েকবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরামর্শ চাওয়া হয়। কোনো নির্দেশনা না পেয়ে তারা আত্মরক্ষার্থে ক্যাম্পের মধ্যে অবস্থান নেন। হামলাকারীরা এ সময় কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। প্রথম দফায় যারা ভাঙচুর চালায় তারা শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভেঙে চলে গেছে। এরপর আরও কয়েক দফায় রাত ১২টা পর্যন্ত সেখানে তারা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের তাণ্ডব চালিয়েছে। সবশেষে ক্যাম্পে এসে আমাদের ওপর আক্রমণ করে অফিস ভাঙচুর করে এবং কন্ট্রোল রুম থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংরক্ষণের হার্ডডিক্সটি খুলে নিয়ে গেছে।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে স্থাপিত আনসার ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবেদার রবিউল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে কোনো নির্দেশনা না পেয়ে আমরা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা ক্যাম্পে এসে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। পরিস্থিতি এমনই ছিল- যেখানে আমাদের কিছুই করার ছিল না। অনুগ্রহ করে আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণের স্থান হিসেবে মেহেরপুরের মুজিবনগর ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শপথ গ্রহণের স্মৃতিকে অম্লান করে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে মুজিবনগরে প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের স্থানে স্থপতি তানভীর কবিরের নকশাতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৮৭ সালের ১৭ এপ্রিল উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলতে ১৯৯৬ সালে ওই স্থানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স স্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্মৃতি কমপ্লেক্সে একটি মানচিত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরকে দেখানো হয়েছিল। কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলির স্মারক ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছিল। সার্বিকভাবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স, ঐতিহাসিক আম্রকানন, ঐতিহাসিক ছয় দফার রূপক উপস্থাপনকারী ছয় ধাপের গোলাপ বাগান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত প্রদর্শন ছিল এখানে।
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের ভেতরের অংশে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ভাস্কর্য। স্মৃতি কমপ্লেক্সের বাইরের অংশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্যসহ আরও ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ওই ভাস্কর্যগুলোই মূলত পর্যটকদের আকর্ষণ করত। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন সেক্টরের অবস্থান বাংলাদেশের মানচিত্রে প্রদর্শন করে মানচিত্রটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরের মূল আঙিনায় স্থাপিত। সুদৃশ্য এ মানচিত্রটি মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন সেক্টরের অবস্থান ও উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি সম্পর্কিত এক প্রামাণ্যচিত্র ছিল, যা দিয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকে যে কারও চোখের সামনে তুলে ধরা সম্ভব ছিল।